প্রকৃতিতে আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এখন নানামাত্রায় দৃশ্যমান। আবহাওয়ার পরিবর্তনের ফলে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বজ্রপাত, ভূমিকম্প এসব প্রকৃতিক দুর্যোগ বেড়েই চলছে। সেই সাথে আবহাওয়ার উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে বাড়ছে নানান রোগ বালাই। উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে রাজধানী ঢাকা বিশ্বের শীর্ষ চরম তাপমাত্রার শহরের তালিকায় উঠে এসেছে। এই চরম তাপমাত্রার কারণে ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
আবহাওয়া বৈরী হয়ে উঠায় দেশে বৃষ্টিপাতে অস্বাভাবিক অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছে। বিভাগ-জেলা বা অঞ্চলভেদে বৃষ্টিপাতে অনিয়ম ব্যাপক। পঞ্জিকার পাতায় বর্তমানে অর্থাৎ গতকাল ছিল আশ্বিনের শেষ দিন। আজ কার্তিক মাসের শুরু। অর্থাৎ ঋতু হিসাবে শরৎকাল শেষ হয়ে শুরু হলো হেমন্ত। এ সময় প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তা থাকার কথা। অথচ গতকাল আশ্বিনের শেষ দিনেও সূর্য চৈত্র মাসের মতো অগুন ছড়াচ্ছিল। হেমন্তের এই আগমনী সময়েও গ্রীষ্মের মতো ভ্যাপসা গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে ঢাকা, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, চাঁদপুর, পাবনা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, যশোর, খুলনা, বরিশাল, ভোলা এবং সিলেট এই ১৮টি জেলার ওপর দিয়ে মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর বিদায় নেওয়ার সময় আশ্বিনের শেষদিনে গরমে পুড়ছে প্রায় সারাদেশ। দেশের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। আবহাওয়াবিদরা বলেন, অক্টোবর মাসে কোনো কোনো বছর তাপমাত্রা বেশি থাকে। কারণ অক্টোবরে এসে বৃষ্টিপাতটা অনেকটাই কমে যায়। সেপ্টেম্বরের চেয়ে অক্টোবরে বৃষ্টিপাত অর্ধেকের চেয়েও কম হয়। এবার স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের চেয়ে অনেক কম বৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া দেশ থেকে যখন দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বিদায় নিচ্ছে, ঠিক ওই সময়েই বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে প্রচুর পরিমাণ জলীয় বাষ্প সমৃদ্ধ বাতাস স্থলভাগের দিকে আসে। যে কারণে ভাদ্র মাসের মতো ভ্যাপসা গরম লাগছে। এ অবস্থায় বৃষ্টি যতক্ষণ না হয়, ততক্ষণ গরম কমে না। আরও দু’দিন এমন গরম পড়তে পারে। এ ছাড়া, আগামী ১৮ অক্টোবর থেকে টানা দুই-তিনদিন বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। বৃষ্টির পর এইগরম কমে যাবে।
আবহাওয়াবিদ মো. আরিফ হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, আগামী দু’তিনদিনের মধ্যে বৃষ্টি হলে তাপমাত্রা কমবে। এখন স্বাভাবিকের চেয়ে তাপমাত্রা ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। রাতের তাপমাত্রাও ২ ডিগ্রির মতো বেশি আছে। তার মতে, মূলত স্বাভাবিক বৃষ্টি না হওয়ার কারণেই এবার এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সাধারণত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে দেশে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বিদায় নিতে শুরু হবে। দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে পুরোপুরি বিদায় নেয়। কোনো কোনো বছর এটা একটু দেরিতে হয়। এবার দেরি হচ্ছে, এবার মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশ থেকে পুরোপুরি বিদায় নিতে ২২/২৩ অক্টোবর পর্যন্ত লেগে যাবে।
বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আইনুন নিশাত ইনকিলাবকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে ঋতুবৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে। অপ্রত্যাশিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দিচ্ছে। যখন বৃষ্টি হওয়ার কথা তখন বৃষ্টি হচ্ছে না। আবার যখন প্রয়োজন নেই তখন হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং শিল্পায়নের ফলে আবহাওয়া ও জলবায়ুর এই বিরূপ প্রভাব। খাল-বিল জলাশয় ভরাট করে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে বহুতল ভবন যা পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে। এ ছাড়া দ্রুত শিল্পায়নের ফলেও উত্তপ্ত আবহাওয়া। এর ফলে দেশে বিভিন্ন দুর্যোগ বাড়ছে। এসব বিষয়ে বারবার বলা হলেও এর প্রতিকারে যথাযথ কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায় না। ফলে প্রকৃতিতে আবহাওয়ার বৈরী প্রভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে।
চলতি ২০২১ সালে বিশ্বজুড়ে আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবে প্রকৃতি টালমাটাল। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, বেলজিয়াম, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড স্মরণকালের ভয়াবহ দাবানল ‘হিট ডোমে’ পুড়েছে। আবার মারাত্মক বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, তুষারঝড় আঘাত হানছে। চীন, ভারত, নেপাল, পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যা, ভূমিধস, কাদার ঢল (মাড-ফ্লো), সউদী আরবে আকস্মিক অতিবৃষ্টি, বন্যা এবং মরু দেশটির অন্যপ্রান্তে তুষারপাত হয়েছে। শীর্ষ জলবায়ু বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, দ্রুতগতিতে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরফলে ব্যাপক বৃষ্টিপাত এবং আরো মারাত্মক ধরনের দাবানল ‘হিট ডোম’ ও তাপদাহ সৃষ্টি হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন