সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

এক শ্রেণির মিডিয়ার একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি

তারেকুল ইসলাম | প্রকাশের সময় : ২২ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৭ এএম

কয়েক মাস আগে নড়াইলের শোলপুরে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় এক হিন্দু যুবক গ্রেফতার হয় এবং সে আদালতে নিজের দোষ স্বীকার করে। এ অপকর্মটি সে কী উদ্দেশ্যে করেছে, তা এখনো জানা যায়নি। লক্ষণীয় হলো, এ ঘটনায় মিডিয়ায় তেমন কোনো হইচই বা নড়চড় দেখা যায়নি।

এ বছরের বিগত মার্চে বগুড়ায় প্রতিমা ভাঙচুরসহ আরেকটি মন্দিরে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে। পরে জানা যায়, সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের দুই পক্ষের মধ্যকার ভূমি বিরোধই সে ঘটনার মূল কারণ (৩০ মার্চ ২০২১, ঢাকা ট্রিবিউিন)। তখনো এ বিষয়ে মিডিয়ার মাতামাতি চোখে পড়েনি। অথচ, হরহামেশা দেখা যায়, সংখ্যালঘু-সম্পর্কিত এ ধরনের ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে দুষ্কৃতিকারীদের পরিচয় জানা কিংবা তাদের চিহ্নিত করার আগেই একশ্রেণির অতিউৎসাহী মিডিয়া কথিত ‘মৌলবাদ’ আর ‘সাম্প্রদায়িকতা’র জিগির তুলে ইসলামপন্থী ও আলেম-ওলামার ওপর অপবাদ দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু অনেক ঘটনায় দোষীদের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ পাওয়ার পর দেখা যায়, ঘটনার সঙ্গে আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থীদের কোনো সম্পৃক্ততাই নেই। ঘটনা বরং উল্টো, তখন সেসব মিডিয়া হঠাৎ চুপসে যায় এবং নীরবে পাশ কেটে যায়।

অর্থশালী-প্রভাবশালী এলিট হিন্দুরা যখন তুলনামূলকভাবে দুর্বল হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করে, তখনো আমাদের সেকুলার নামধারী মিডিয়াগোষ্ঠিকে নীরব ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। চলতি বছরের জুনেই চট্টগ্রামে অবস্থিত প্রবর্তক সংঘ নামে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি সংগঠন সংবাদ সম্মেলন করে ইসকনের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ আনে। সংগঠনটি একইসাথে ইসকনের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ ও ‘নাশকতার পরিকল্পনা’ করারও অভিযোগ তোলে। অথচ, এ বিষয়টি ইনকিলাব ছাড়া মূলধারার বেশিরভাগ মিডিয়া লক্ষণীয়ভাবে এড়িয়ে গিয়েছিল। অথচ, প্রবর্তক সংঘ যদি কোনো মুসলিম সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতো, তাহলে তথাকথিত সেকুলার মিডিয়াগোষ্ঠি যে তোলপাড় করে ফেলতো, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

আমাদের দেশে সময়ে-সময়ে মন্দিরে বা হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে রহস্যময় ‘দুর্বৃত্ত’দের হামলা বা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে থাকে। এ বছরের জুলাই মাসে কোরবানির ঈদের পরদিন সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার একটি গ্রামের কালীমন্দিরের দরজায় কারা যেন দড়ি দিয়ে গরুর ভুঁড়ি বেঁধে রেখে যায়। মিডিয়ায় ‘দুর্বৃত্ত’ শব্দ উল্লেখ করলেও এখন পর্যন্ত ওই ঘটনায় জড়িত দুর্বৃত্তদের পরিচয় জানা যায়নি। অথচ, ঘটনার পরপরই ওই গ্রামের মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন সেখানকার হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে। ওই কথিত দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত করার আগেই সেখানকার মুসলমানদের ক্ষমা প্রার্থনা করার মতো এমন জরুরি পরিস্থিতিতে পড়তে হলো! তাহলে বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ঘটনা মুসলমানদের সাম্প্রদায়িক হিসেবে চিত্রিত করা এবং তাদের বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে সংঘটিত কিনা, এমন প্রশ্ন উঠতেই পারে কোনো কোনো মিডিয়ায় ‘সাম্প্রদায়িকতা’র জিগির তোলা হলেও ওই রহস্যময় দুর্বৃত্তদের পরিচয় কস্মিনকালেও আর জানা যায় না, বিচার তো দূরের কথা!

বিগত ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ফেসবুকে মুসলিম নামধারী একটি আইডি থেকে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটকে হত্যার হুমকি দেয়ার অভিযোগে সুজন কুমার নামে এক হিন্দু যুবককে গ্রেফতার করা হয়। সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, সে ফেসবুকে ‘হাসান রুহানি’ নামে আইডি খুলে ধর্মীয় উসকানিমূলক বক্তব্য প্রচার করতো। ওই যুবককে তখন দু’দিনের রিমান্ডে নেয়া হলেও তার পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য কী ছিল, সে বিষয়ে আজ পর্যন্ত কিছু জানা যায়নি। হিন্দু হওয়ায় মিডিয়া তাকে ‘জঙ্গি’ বানায়নি, কিন্তু মুসলিম হলে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ভিন্ন হতো।

যাই হোক, মুসলিম ছদ্মবেশ ধারণ করে ঘটনা ঘটিয়ে মুসলমানদের বদনাম করার তরিকা তো ভারতীয় উগ্রবাদী মুসলিমবিদ্বেষী সংগঠন আরএসএস ও বিজেপি’র। ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে ভারতের উত্তর প্রদেশের একটি এলাকায় বোরকা পরে মন্দিরে গরুর গোশত ছুঁড়ে পালানোর সময় হাতেনাতে ধরা পড়েছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) এক কর্মী। এছাড়া, ভারতজুড়ে যখন ‘নাগরিকত্ব সংশোধন আইনে’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ চলছিল, ঠিক তখন মুসলমানদের বদনাম করার উদ্দেশ্যে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় মুসলিম ফেজটুপি পরে ছদ্মবেশে ট্রেনে ভাঙচুর চালানোর সময় আটক হয়েছিল ছয় বিজেপি কর্মী। এ ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এক প্রতিবাদ সমাবেশে বলেছিলেন: ‘বিজেপির ফাঁদে পা দেবেন না। ওরা হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করতে চাইছে। ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট পেয়েছি, বিজেপি তাদের কর্মীদের জন্য ফেজটুপি কিনছে, যাতে সহিংসতার সময় ছবি তুলে মুসলিম সম্প্রদায়ের বদনাম করতে পারে। যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে সহিংসতা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করে ভুয়া ভিডিও তৈরি করছে’ (২০ ডিসেম্বর ২০১৯, সংবাদ প্রতিদিন)।

ছদ্মবেশে স্যাবোট্যাজ করে মুসলমানদের ওপর অপবাদ দিয়ে এবং হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা বাঁধানো আরএসএস ও বিজেপি’র পুরনো কৌশল। আর ওই একই কৌশল এদেশেও অনুসৃত হতে দেখা যায়। ২০১৯ সালের জুলাইতে প্রিয়া সাহা আমেরিকায় গিয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করেছিলেন যে, বাংলাদেশে ‘মুসলিম মৌলবাদী গোষ্ঠি’ তার ঘরবাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে এবং তার জমি কেড়ে নিয়েছে। অথচ, তার গ্রামের স্থানীয় হিন্দু নেতারাই সংবাদমাধ্যমে বলেছিল যে জমি বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ও হয়রানি করতেই পরিকল্পিতভাবে রাতের বেলায় প্রিয়া সাহা তার ভাইয়ের জমিতে সাজানো অগ্নিসংযোগ ঘটান (২১ জুলাই ২০১৯, দেশ রূপান্তর)।

সাধারণত এ দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের বাড়িঘর বা তাদের উপাসনালয়ে কোনো ধরনের আক্রমণ বা হামলা হলেই চিহ্নিত কিছু মিডিয়া সেটাকে ব্যাপকভাবে হাইলাইট করে থাকে। হাইলাইট করুক তাতে সমস্যা নেই; কিন্তু সেটার উদ্দেশ্য যদি হয় অনর্থক সাম্প্রদায়িকতার হাইপ তোলা, তাহলে তো সমস্যা বটেই। কারণ, এ ধরনের প্রতিটি ঘটনার নেপথ্য ইস্যু সাম্প্রদায়িকতা নয়, বরং বেশিরভাগ ঘটনায় প্রধানত ভূমিদস্যুতা ও ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িত থাকে। আর সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগের আড়ালে সেসব অপরাধ প্রকারান্তরে চাপা পড়ে যায়।

সুষ্ঠু তদন্ত কিংবা যাচাই-বাছাই করার আগেই একতরফাভাবে সাম্প্রদায়িকতার হুজুগ তুলে কখনো আকারে-ইঙ্গিতে আবার কখনো সরাসরি এদেশের আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থীদের অপবাদ দেয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। আর এই বিশেষ অপবাদভিত্তিক বয়ান জারি রাখে এ দেশেরই একশ্রেণির মিডিয়া। যার ফলে সংখ্যালঘু ট্রাম্পকার্ড নিয়ে এপারে রাজনীতি করার সুযোগ পায় একটি মহল। আর ওপারে মুসলিমবিদ্বেষী এজেন্ডা চরিতার্থ করে হিন্দুত্ববাদী আরএসএস-বিজেপি-বজরং গোষ্ঠি।

বাংলাদেশি সেসব মিডিয়ার সূত্রে ভারতীয় মিডিয়াতেও সমান্তরালে অপপ্রচার চালানো হয় যে, বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতন হচ্ছে। সেখানে মুসলমানরা সংখ্যালঘু হিন্দুদের জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারছে... ইত্যাদি। আর এ সুযোগে উগ্রবাদী ক্ষমতাসীন বিজেপি ও আরএসএস ভারতীয় মুসলমানদের আরো অত্যাচার করার সুযোগ পায় এবং মুসলিমবিদ্বেষী প্রোপাগান্ডা চালিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ভোট বাগানোর চেষ্টা করে।

পরিশেষে বলবো, উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। কিন্তু এখানে সুশাসন বা আইনের শাসনের অভাবে দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার ক্রমাগতভাবে বাড়ছে। ব্যাপারটা এমন নয় যে, সংখ্যাগরিষ্ঠরা খুব সুখে-শান্তিতে-নিরাপদে আছে। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে দুর্বল-অসহায়রা দুঃশাসনের শিকার। দুর্বল সে হিন্দু হোক বা মুসলিম হোক, তার বাড়িঘর ও জানমালের ওপর সবলের হামলা, লুটপাট ও জমি দখল এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সুতরাং, মিডিয়ার উচিত আলাদাভাবে ‘সংখ্যালঘু বর্গ’ তৈরি না করে দেশের সবাইকে সমান নাগরিক হিসেবে দেখা এবং দল-মত ও ধর্ম নির্বিশেষে যে কারো নাগরিক ও মানবিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে তা বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরা।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন