চাহিদা বাড়ায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে মার্কিন ডলারের দাম। এতে করে মান হারাচ্ছে টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার বিক্রি করেও দামের ঊর্ধ্বগতি ঠেকাতে পারছে না। এমনকি উপায় না পেয়ে ব্যাংকগুলোও ডলারের দর বাড়িয়েই চলেছে। কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে প্রতিদিনই বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দর। গতকালও সোনালী ব্যাংক থেকে ১ ডলার কিনতে হাতে গুণে ৯০ টাকা দিতে হয়েছে। জনতা ব্যাংক ডলার বিক্রি করেছে ৮৯ টাকা ৫০ পয়সায়, অগ্রণী ব্যাংকে কিনতে দিতে হয়েছে ৮৯ টাকা ৪০ পয়সা। বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলো আরও বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে। রাষ্ট্রায়ত্ত এই তিনটি ব্যাংক এক দিনের ব্যবধানেই প্রতি ডলারের দাম এক টাকা করে বাড়িয়ে দিয়েছে। আর এ কারণে খোলাবাজারে ডলারের দাম বেড়ে ৯১ থেকে ৯৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে অবশ্য গতকালও ডলার বিক্রি দেখানো হয়েছে, ৮৫ টাকা ৮০ পয়সায়।
এ হিসাবে আন্তব্যাংক রেটের চেয়ে ৪ থেকে ৫ টাকা বেশি দামে নগদ ডলার বিক্রি করছে ব্যাংকগুলো। অথচ এই ব্যবধান বা পার্থক্য এক-দেড় টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। খোলা বাজারে ডলার বিক্রি হচ্ছে ৬ টাকা বেশি দামে। মতিঝিলের একটি মানি এক্সচেঞ্জের মালিক আবুল বাশার ইনকিলাবকে বলেন, আমাদেরই গতকাল (সোমবার) ব্যাংক থেকে ৯০ টাকা দরে ডলার কিনতে হয়েছে। তাহলে বিক্রি করবো কতো বলেন প্রশ্ন রাখেন। তিনি জানান, আমি ৯০ টাকা ৫০ পয়সায় বিক্রি করেছি। তবে অনেকেই আরও বেশি টাকায় ডলার বিক্রি করেছে।
খোলাবাজারের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো হাত নেই। তবে, ব্যাংকগুলো বেশি দামে ডলার বিক্রি করলে বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তক্ষেপ করে থাকে। কেননা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আন্তব্যাংক দরে ডলার কিনে সেই ডলার বিক্রি করে থাকে ব্যাংকগুলো।
এর আগে দেখা গেছে, ব্যাংকগুলোর বিক্রি করা ডলারের দর আর আন্তব্যাংক রেটের মধ্যে বেশি ব্যবধান হলে বাংলাদেশ ব্যাংক সেই পার্থক্যের একটা সীমা নির্ধারণ করে দিত; সেটা এক থেকে দুই টাকার মধ্যে থাকত। কিন্তু গত তিন মাস ধরে ব্যাংকগুলো আন্তব্যাংক রেটের চেয়ে চার-সাড়ে চার টাকা বেশি দামে ডলার বিক্রি করলেও এখন পর্যন্ত কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। সে কারণেই দিন যতো যাচ্ছে, ইচ্ছে মতো যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দাম বাড়িয়ে চলেছে ব্যাংকগুলো; কমছে টাকার মান। এ পরিস্থিতিতে আমদানি খরচ বেড়েই যাচ্ছে; গেছে; বাড়ছে পণ্যের দাম। তবে, রফতানিকারক ও প্রবাসীরা লাভবান হচ্ছেন।
এদিকে কম সুদের বলে বিদেশি ঋণ গ্রহণ করা ব্যবসায়ীরা ডলারের দর বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছেন। ফলে দেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে সুদ-আসলে যে টাকা পরিশোধ করতে হতো, এখন তাদের পরিশোধ করতে হবে তার চেয়ে বেশি। দেশে বাড়ছে শিল্প উৎপাদন। উন্মোচন করা হচ্ছে সম্ভাবনার নতুন দ্বার। তবে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অর্থায়ন এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থায়নের জন্য দেশি উৎসের পাশাপাশি এখন বেশিসংখ্যক উদ্যোক্তা বিদেশি ঋণে ঝুঁকছেন। বলা হচ্ছে দেশের তুলনায়, বিদেশি ঋণে সুদহার কম। তবে ঋণের অর্থ ডলার বা অন্য কোনো মুদ্রায় দেশে আসে আর তা পরিশোধও করতে হয় বিদেশি সেই মুদ্রায়। এ কারণে বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার যদি বেড়ে যায়, তাহলে ঋণগ্রহীতাদের বেশি দামে তা কিনতে হবে। ফলে তাদের প্রত্যাশিত অর্থের চেয়ে বেশি পরিশোধ করতে হতে পারে।
এই ঘটনাটিই ঘটছে সম্প্রতি। টানা কয়েক বছর টাকার সঙ্গে বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকলেও এখন পরিস্থিতি অন্য রকম। ডলারের দর হঠাৎ করেই এখন চড়া। আন্তব্যাংকে প্রতি ডলার বিনিময় হার এখন ৮৫ দশমিক ৮০ টাকা। তবে বছর কয়েক আগেও ছিল ৭৬ থেকে ৭৭ টাকা। ফলে সে সময় যারা ঋণ নিয়েছেন ঋণগ্রহীতাদের প্রত্যাশিত অর্থের চেয়ে বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে।
সবমিলিয়ে ডলারের এই ঊর্ধ্বগতি দেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়ছে- এ প্রশ্নের উত্তরে অর্থনীতির বিশ্লেষক, গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, সত্যিই ডলারের বাজারে চরম অস্থিরতা চলছে। এটা কোথায় গিয়ে শেষ হবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করেও বাজার স্বাভাবিক রাখতে পারছে না। আমার মনে হয়, এভাবে হস্তক্ষেপ করে বাজার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে না। কেননা, সরবরাহ এবং চাহিদার মধ্যে ব্যাপক তফাত। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় আমদানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে; ৫০ শতাংশের বেশি। কিন্তু রেমিট্যান্স না বেড়ে উল্টো ২০ শতাংশ কমেছে। রফতানি বাড়ছে ঠিকই, কিন্তু তা চাহিদার চেয়ে অনেক কম।
বিশ্লেষকদের মতে, কতোদিন এই অস্থিরতা চলবে। আমদানি আগামী ছয় মাস-এক বছরের মধ্যে কমবে বলে মনে হয় না। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমারও কোনো লক্ষণ নেই। সে পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের ওপর চাপ আরও বাড়বে। দুই-আড়াই মাস আগেও রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এখন ৪৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।
তাহলে সমাধান কী-এ প্রশ্নের উত্তরে দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা আহসান মনসুর বলেন, আমি মনে করি, রিজার্ভ থেকে বাজারে ডলার ছেড়ে হস্তক্ষেপ করে পার্মানেন্ট কোনো সল্যুশন (স্থায়ী সমাধান) হবে না। বাজারকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হলে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতটা একটু গুটিয়ে ফেলতে হবে; হস্তক্ষেপ তুলে নিতে হবে। বাজারকে বাজারের মতো চলতে দিতে হবে; বাজারকে বাজারের গতিতেই যেতে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে যদি ইন্টারব্যাংক রেট ৮৭ টাকাও হয়, তাও যেতে দিতে হবে। তাহলে, ব্যাংকগুলো ও কার্ব মার্কেটের সঙ্গে ব্যাংক রেটে ডলারের যে পার্থক্য তা কমে আসবে। ধীরে ধীরে বাজার স্থিতিশীল-স্বাভাবিক হয়ে আসবে। আমি মনে করি, সেটাই হবে একটা স্থায়ী সমাধান।
ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার আসার বড় মাধ্যম রফতানি আয়, প্রবাসী আয় এবং বিদেশি অনুদান ও ঋণ। আর ডলার ব্যয় হয় আমদানি এবং বিদেশি সেবা, শিক্ষা, চিকিৎসা, যাতায়াত ও বেতন-ভাতার খরচ মেটাতে। এ ছাড়া আমদানি খরচও (জাহাজ ভাড়া) বৃদ্ধি পেয়েছে। সব মিলিয়ে ডলার খরচ বেড়ে যাওয়ায় মুদ্রাটির দাম বাড়ছে। যে কারণে বাড়ছে ভোগ্যপণ্যের দাম। এর প্রভাব পড়েছে দেশের পুরো অর্থনীতিতে, যা অস্বস্তিতে ফেলেছে জনগণকে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, পণ্য ও মূলধনি যন্ত্রপাতি এত আসছে কি না, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। কারণ, হঠাৎ আমদানি বেড়ে যাওয়ায় ডলারের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। ব্যাংকগুলো সীমার বেশি ডলার ধারণ করে দাম বাড়াচ্ছে কি না, তাও দেখতে হবে। ডলারের দাম মূলত আমদানি-সরবরাহের ওপর নির্ভর করে। দাম ধরে না রেখে আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গে ডলারের দাম সমন্বয় করতে হবে। প্রবাসী আয় বাড়াতে দক্ষ জনবল পাঠানো ও আয় আনা আরও সহজ করতে হবে।
গত আগস্ট থেকে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ছে। আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারেই এই সাড়ে তিন মাসের ব্যবধানে ডলারের বিপরীতে টাকা ১ টাকা দর হারিয়েছে। ৫ আগস্ট আন্তব্যাংক লেনদেনে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে একই জায়গায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর। বাড়তে বাড়তে গতকাল তা ৮৫ টাকা ৮০ পয়সায় উঠেছে। বাজারের চাহিদা বিবেচনায় প্রচুর ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১৯ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে প্রায় ২০০ কোটি (২ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন