কিছুতেই বাগে আসছে না ডলারের বাজার। এবার ব্যাংকেও প্রতি ডলারের দাম পৌঁছেছে ১০৮ টাকায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দিচ্ছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকেরা। খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের মনিটরিং টিম কাজ করায় ডলারের দর খানিকটা কমেছে। তবে ব্যাংকগুলো ইচ্ছেমতো দামে বিক্রি করছে নগদ ডলার। এতে কার্ব মার্কেট ও ব্যাংকে ডলারের দর সমান হয়ে গেছে। বেসরকারি ইষ্টার্ন ব্যাংক এক দিনের ব্যবধানে ৭ টাকা বাড়িয়ে বুধবার প্রতি ডলার ১০৮ টাকায় বিক্রি করেছে। গত মঙ্গলবার এই ব্যাংকে ডলারের দাম ছিল ১০১ টাকা। আইএফআইসি ও সিটি ব্যাংক থেকে এক ডলার কিনতে বুধবার গুনতে হয়েছে ১০৭ টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংক ১০৩ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে। অন্য তিন সরকারি ব্যাংক সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংক বিক্রি করেছে ১০২ টাকায়। খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলারের দামে অবশ্য বেশ খানিকটা লাগাম পড়েছে। গতকাল বুধবার বেলা দেড়টার দিকে প্রতি ডলার বিক্রি হয়েছে ১০৯ টাকায়। গত মঙ্গলবার এক লাফে দাম ৬ টাকা বেড়ে ১১২ টাকায় উঠে গিয়েছিল। ভ্রমণ, শিক্ষা, জরুরি প্রয়োজন কিংবা চিকিৎসার জন্য কেউ বিদেশে যেতে চাইলে এখন ব্যাংক বা খোলাবাজার যেখান থেকেই ডলার কিনুন না কেন একই দাম গুনতে হচ্ছে। অথচ গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের বেঁধে দেয়া আন্তব্যাংক দর (ব্যাংক রেট) ছিল ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা। এই দামে ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে ব্যাংকগুলো এই দরের চেয়ে ৮ থেকে ১৩ টাকা বেশি দামে ডলার বিক্রি করেছে। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক গতকাল বাজার মনিটরিং শুরু করেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, একটি চক্র খোলাবাজারে ডলারের দামে সিন্ডিকেট করে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি কঠোর মনিটরিং টিম করেছে। একই সঙ্গে সবাইকে খোলাবাজারে ডলারের লেনদেন না করে ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেন করার অনুরোধ করেছেন।
খোলাবাজারের প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, কিন্তু ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ বা তদারকির মধ্যে থেকে ডলার লেনদেন করে থাকে। সাধারণত ব্যাংক রেটের ব্যাংকগুলোতে ডলারের দর দেড় থেকে দুই টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ব্যাংক রেটের চেয়ে ৬/৭ টাকা বেশি দামে ডলার বিক্রি করছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলো ১৩ টাকা বেশি দামে বিক্রি করছে।
ব্যাংক রেটের চেয়ে ব্যাংকগুলোর ডলারের দামের এত ব্যবধান কেন- জানতে চাইলে অর্থনীতির বিশ্লেষক গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, এখন আর ইন্টারব্যাংক রেট বলে কিছু নেই। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কাছে অল্প কিছু ডলার বিক্রি করে। সেটা দিয়ে ব্যাংকগুলোর কিছুই হয় না। সব ব্যাংক পায় না। যেসব ব্যাংক জ্বালানি তেলসহ সরকারের অন্য পণ্য আমদানির এলসি খোলে, তারাই পায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলার।
তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বাজারে ডলারের চরম সঙ্কট চলছে। পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার প্রয়োজনীয় ডলার নেই ব্যাংকগুলোর কাছে। বেশি দামে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেও চাহিদা মিটছে না। সে কারণে বেশি দামে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে। বাধ্য হয়ে তাকে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান বলেন, দাম আরও বাড়বে-এমন গুজবে সাধারণ মানুষ এখন শেয়ারবাজারে লোকসানে শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে ডলার কিনছে। অনেকে আবার তিন-চার মাস পর দেশের বাইরে যাবেন, তাই প্রয়োজনীয় ডলার এখনই কিনে রাখছেন। সব মিলিয়ে মুদ্রাবাজারে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। এ অবস্থা থাকলে অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিপদ দেখা দিতে পারে। তাই যত দ্রুত সম্ভব ডলারকে মাটিতে নামিয়ে আনতে হবে। টাকাকে শক্তিশালী করতে হবে।
কীভাবে সেটা সম্ভব- এ প্রশ্নের উত্তরে আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমি মনে করি এ ক্ষেত্রে একটাই পথ আছে, সেটা হচ্ছে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দেয়া। সেটা অল্প সময়ের জন্য ১৫ থেকে ২০ শতাংশও বাড়িয়ে দেয়া যেতে পারে। যে কাজটি রাশিয়া করেছিল এবং সফল হয়েছে। তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলার পর রুবলের দাম এক ধাক্কায় অনেক পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদের হার অনেক বাড়িয়ে দেয়। বেড়ে যায় রুবলের কদর। বাড়তে থাকে মান।
দীর্ঘদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলে (আইএমএফ) গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা আহসান এইচ মনসুর বলেন, আমাদের এই মুহূর্তে ঠিক এই কাজটিই করতে হবে। এক্ষুনি সেটা করতে হবে। বর্তমানে আমাদের সুদের হার ৯ শতাংশ। সেটা ১৫/২০ শতাংশ করা হলে বাজারে টাকার সরবরাহ কমে আসবে। পর্যাপ্ত টাকা না থাকলে কেউ আর ডলার কিনতে যাবে না। তখন এমনিতেই ডলারের দাম কমে আসবে। একই সঙ্গে আমদানির লাগাম টানতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে তা অব্যাহত রাখতে হবে। রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়ানোর দিকে জোর দিতে হবে।
বাজার ‘স্থিতিশীল’ করতে গত অর্থবছরের ধারাবাহিকতায় নতুন অর্থবছরেও বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত মঙ্গলবারও ৫ কোটি ডলার বিক্রি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের ২৬ দিনে (১ থেকে ২৬ জুলাই) প্রায় ১০০ কোটি (এক বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে। তারপরও বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না। দিন যত যাচ্ছে, মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা ততই বাড়ছে। পাগলা ঘোড়ার মতোই ছুটছে ডলার। নিয়মিত দামি হচ্ছে, সেই সঙ্গে পড়ছে টাকার মান। এর ফলে রিজার্ভ দুই বছর পর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসার পর আর ওপরে উঠছে না। গত মঙ্গলবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৩৯ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। বেশ কিছুদিন ধরে চলা ডলারের অস্থির বাজারে ‘স্থিতিশীলতা’ আনতে বিলাসবহুল এবং অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির লাগাম টেনে ধরতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটার পর একটা পদক্ষেপ নিচ্ছে, কিন্তু বাজার স্বাভাবিক হচ্ছে না।
মুদ্রাবাজার স্বাভাবিক রাখতে ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি (৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই রিজার্ভ থেকে এক অর্থবছরে এত ডলার বিক্রি করা হয়নি। অথচ তার আগের অর্থবছরে (২০২০-২১) বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়ায় দর ধরে রাখতে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন (৮০০ কোটি) ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ যে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছিল, তাতে ডলার কেনার অবদান ছিল।
আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স কমে যাওয়ার কারণেই মূলত দেশে ডলারের এই সঙ্কট দেখা দিয়েছে। রফতানি আয় বাড়লেও ডলারের সঙ্কট মেটাতে পারছে না। ফলে প্রতিনিয়ত বেড়েছে ডলারের দাম। এ জন্য রিজার্ভ থেকে ডলার ছেড়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতিনিয়ত দামও বাড়িয়েছে। এরপরও কিছুতেই বাগে আসছে না ডলারের তেজিভাব। গত বছরের আগস্ট থেকে ডলারের দাম বাড়তে শুরু করে; দুর্বল হতে থাকে টাকা। তার আগে এক বছরেরও বেশি সময় ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর।
করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছরজুড়ে আমদানি বেশ কমে গিয়েছিল। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রফতানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। সে পরিস্থিতিতে ডলারের দর ধরে রাখতে ওই অর্থবছরে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারই ধারাবাহিকতায় বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনা হয়।
আগস্ট মাস থেকে দেখা যায় উল্টো চিত্র। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে আমদানি ব্যয়। রফতানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়; বাড়তে থাকে দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগস্ট থেকে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক, চলে পুরো অর্থবছর। সেই ধারাবাহিকতায় চাহিদা মেটাতে নতুন অর্থবছরেও (২০২২-২৩) ডলার বিক্রি অব্যাহত রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই একই জায়গায় ‘স্থির’ ছিল ডলার। এর পর থেকেই বাড়তে থাকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রার দর। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে, এক বছরে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে ডলারের দর বেড়েছে ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন