সবচেয়ে শক্তিধর অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলার যুগ যুগ ধরে বিশ্ব অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। বাণিজ্যের স্বার্থে চীন, ভারত, বাংলাদেশসহ প্রায় সব দেশ বিভিন্ন সময়ে ডলারের বিপরীতে নিজেদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছে। এতে আরও শক্তিশালী হয়েছে ডলার। রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানে ডলারের বিপরীতে অনেক দেশের মুদ্রার মান আরেক দফা কমেছে। ভারতে প্রতি ডলারের জন্য এখন গুনতে হচ্ছে ৭৬ টাকা ৩৬ পয়সা। বাংলাদেশে লাগছে ৮৬ টাকা ২০ পয়সা। এর আগে আর কখনও ডলারের বিপরীতে এতটা দর হারায়নি ভারতীয় রুপি ও বাংলাদেশি মুদ্রা টাকা।
অভিযানের শুরুতে সবচেয়ে বড় দরপতন হয় রাশিয়ান মুদ্রা রুবলের। ইউক্রেনে হামলার জেরে পশ্চিমা দেশগুলোর একের পর এক নিষেধাজ্ঞার কারণে রুবলের মান কমতে কমতে গত ৭ মার্চ আমেরিকান ডলারের বিপরীতে মান ১৩২ এ নেমে আসে। অর্থাৎ ১ ডলারের জন্য খরচ করতে হয় ১৩২ রুবল।
তবে গত বুধবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের একটি ঘোষণা সবকিছু ওলোটপালট করে দিয়েছে। পুতিন বলেছেন, রাশিয়ার বিপক্ষে অবস্থান নেয়া দেশগুলোর কাছে ডলারের পরিবর্তে রুবলে গ্যাস বিক্রি করবে মস্কো। জ্বালানি চাহিদা মেটাতে ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ানির্ভর হওয়ায় পুতিনের এ ঘোষণা ইউরোর পাশাপাশি ডলারের জন্যও বড় ধাক্কা তৈরি করেছে।
রুশ প্রেসিডেন্টের ঘোষণার পরেই গত বুধবার ডলারের তুলনায় রুবলের মান তিন সপ্তাহের মধ্যে বেড়ে সর্বোচ্চ হয়। ১ ডলারের বিপরীতে দাম ১০০-এর নিচে নেমে ৯৫-এ স্থির হয়েছে রুবল। ইউরোর বিপরীতেও দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। প্রতি ইউরো গত বৃহস্পতিবার বিনিময় হয় ১১০ দশমিক ৫ রুবলে।
রুবলকে শক্তিশালী করতে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করেছে রাশিয়া। বিপক্ষে অবস্থান নেয়া দেশের বাইরে অন্য দেশগুলোর সঙ্গেও আলোচনা শুরু করেছে মস্কো। এরই মধ্যে ভারত রাশিয়া থেকে রুবলে তেল কেনার ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশ ও রাশিয়ার মধ্যে বাণিজ্য রুবল-টাকার মাধ্যমে করার বিষয়টি অনেক দূর এগিয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকায় দেশটির রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার ম্যানটিটস্কি।
এমন উদ্যোগ কার্যকর হলে বিশ্ব মুদ্রাবাজারে আমেরিকান ডলারের ‘একক আধিপত্য’ খর্ব হতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতির বিশ্লেষকরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে সত্যিই একটা জটিল পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এই যুদ্ধ বিশ্বকে মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। চীন, ভারতসহ রাশিয়ার মোটামুটি মিত্র দেশগুলো তাদের আমদানি-রফতানি ডলারের পরিবর্তে নিজ নিজ দেশের মুদ্রায় শুরু করে দিলে কিন্তু ডলারের সেই একক আধিপত্য আর থাকবে না। আর রাশিয়ার গ্যাসের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ইউরোপের দেশগুলোকে যদি ডলারের পরিবর্তে রুবলে গ্যাস কিনতে হয় তাহলেও ডলার দুর্বল হয়ে যাবে।
তিনি বলেন, রাশিয়ার আর্থিক লেনদেনের ওপর চলমান নিষেধাজ্ঞার কারণে সুইফট সিস্টেমের বাইরে গিয়ে চীনের মুদ্রা বা টাকা ও রুবলে লেনদেনের বিষয়টি নিয়ে ঢাকা ও মস্কো যেটা ভাবছে, সেটা সম্ভব। তবে এতে কিছুটা সময় লাগবে। দুই দেশের এ বিষয়ে অনেক কাজ করতে হবে।
অন্যদিকে, ডলারের বদলে চীনের মুদ্রা ইউয়ানের মাধ্যমে তেলের দাম পরিশোধের বিষয়ে দেশটির সঙ্গে আলোচনা চলছে সউদী আরবের। রিয়াদ-বেইজিংয়ের আলোচনা নিয়ে গত ১৬ মার্চ ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে বলা হয়, এমন উদ্যোগে বৈশ্বিক পেট্রোলিয়াম বাজারে ডলারের আধিপত্য কমতে পারে। সউদী আরবের রফতানি করা তেলের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি কিনছে চীন। এই বিক্রি ইউয়ানে হলে চীনের মুদ্রার মান বৃদ্ধি পাবে।
চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) রাশিয়াতে ৫৩ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়েরর চেয়ে ৩২ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। গত ২০২০-২১ অর্থবছরের এই আট মাসে ৪০ কোটি ১২ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছিল। রাশিয়াতে প্রধানত তৈরি পোশাক, হোম টেক্সটাইল, পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন