বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ

জালাল উদ্দিন ওমর | প্রকাশের সময় : ২০ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৬ এএম

হাজারো চ্যালেঞ্জ সত্তে¡ও উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। আমরা ২০১৫ সালেই নি¤œ আয়ের দেশ হতে নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। কোনো দেশের নাগরিকদের মাথাপিছু আয় ১০৪৫ ডলার বা তার নিচে হলে তাদের নি¤œ আয়ের দেশ বলা হয়। ২০২১ সালের শেষে আমাদের মাথাপিছু আয় ২৫০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এগুলো উচ্চ শিক্ষার সুযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ করে চলেছি। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাধ্যমে আমরা বিশ্ব পরমাণু ক্লাবে প্রবেশ করেছি। নারীর শিক্ষা, বাল্য বিবাহ বন্ধ এবং নারীর ক্ষমতায়নে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি। সরকারি চাকরিতে নারীর সংখ্যা এখন চার লাখের বেশি এবং তা দিন দিন বেড়ে চলেছে। বর্তমান প্রশাসন, পুলিশ, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সর্বক্ষেত্রে নারীরা যোগ্যতার সাথে দায়িত্ব পালন করছে। পোশাক শিল্পে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের রফতানি আয়ের শতকরা ৮০ ভাগই পোশাক খাত থেকে অর্জিত হচ্ছে। পোশাক খাতের পর সবচেয়ে বেশি আয় আসছে রেমিট্যান্স খাত থেকে। বিদেশে বর্তমানে প্রায় ৮০ লক্ষ বাংলাদেশি কর্মরত আছে। ২০২০-২০২১ সালে তারা ২৪৭৭ কোটি ডলার পাঠিয়েছে। চামড়া শিল্পেও আমরা এগিয়ে চলছি। ঔষধ শিল্পে আমাদের সফলতা ঈর্ষণীয়। ঔষধের আভ্যন্তরীন বাজারমূল্য ১৫০০০ কোটি টাকা। এর ৯৮ শতাংশই আমরা নিজেরা পূরণ করছি। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর প্রায় ১২৭টি দেশে ঔষধ রফতানি করে। বাইসাইকেল রফতানির ক্ষেত্রে আমরা বেশ সফলতা অর্জন করেছি। পালস্টিক পণ্য এবং শিশুর খেলনা রফতানিতেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপের শিশুদের হাতে বাংলাদেশের তৈরি খেলনা শোভা পাচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সরকার যে ইকোনোমিক জোন প্রতিষ্ঠা করছে তা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। জাপানের হোন্ডা মোটর কর্পোরেশন মোটর সাইকেল প্রস্তুতের জন্য বাংলাদেশে হোন্ডা কারখানা স্থাপন করছে। এটা বিদেশি বিনিয়োগের একটি মাইলফলক। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা অতিব উজ্বল। জাতিসংঘের প্রায় প্রতিটি মিশনেই বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করেছে। এ পর্যন্ত দেড় লক্ষাধিক বাংলাদেশি শান্তি মিশনে কাজ করেছে। পাটের সুদিন আবার ফিরে আসছে। পাটের পেটেন্ট পেয়েছে বাংলাদেশ। ২০১১ সালে ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসবে ১৫ হাজার অংশগ্রহণকারীর হাতে যে আকর্ষণীয় ডিজাইনের পাটের ব্যাগ তুলে দেয়া হয়েছিল সেগুলো ছিল বাংলাদেশের তৈরি। সময়ের সাথে সাথে পাট পণ্যের ব্যবহার, চাহিদা এবং রফতানি বাড়ছে। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। ইলিশের উৎপাদনেও আমরা সফলতা অর্জন করেছি। রফতানি খাতে পোশাক শিল্পের পরই মাছের অবস্থান। মাছ রফতানির পাশাপাশি আমরা কাকড়া রফতানি করছি। ফল উৎপাদনের ক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে চলছি। বাংলাদেশ এখন বিশ্বে পেয়ারা উৎপাদনে সপ্তম এবং আম উৎপাদনে অষ্টম। এসবের পাশাপাশি আমরা শাকসবজি ও রফতানি করছি। ব্রয়লার মুরগী এবং ডিম উৎপাদনে আমরা প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। মুরগীর খাদ্য উৎপাদনেও আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি। ডেইরি শিল্পের উন্নয়নেও আমরা এগিয়ে চলছি। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আমরা সফলতা অর্জন করেছি এবং এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা মহাকাশে নিজস্ব স্যাটেলাইট প্রেরণ করেছি। আমরা টিভি, ফ্রিজ ঊৎপাদন করছি এবং রফতানিও করছি। দেশেই তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন ব্রান্ডের মোবাইল। জাহাজ নির্মাণ শিল্পেও পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশ জাহাজ নির্মাণ করছে এবং সেই জাহাজ বিশ্ব বাজারে রফতানি করছে। সিমেন্ট উপাদনেও আমরা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং রফতানিও করছি। রড, টেউটিন, সিরামিক, টাইলস, রঙসহ নির্মাণ সামগ্রীতেও আমরা স্বনির্ভরতা অর্জন করেছি। এসবের পাশাপাশি স্যানিটেশনেও আমরা যথেষ্ট উন্নতি করেছি। এভাবেই সর্বক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।

সরকারের গৃহীত বেশ কিছু মেগাপ্রজেক্ট বাংলাদেশের চলমান উন্নয়নকে আরো ত্বরান্বিত, গতিশীল ও বেগবান করবে বলে আশা করা যায়। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত প্রকল্প, পদ্মাসেতু, ঢাকায় মেট্রো রেল, মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল, কোরিয়ান ইপিজেড, চায়না ইকোনমিক জোন, মহেশখালীতে গভীর সমুদ্র বন্দর, মহেশখালী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁশখালীতে এস আলম গ্রæপের কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, চট্টগ্রাম হতে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল লাইন প্রকল্প, কক্সবাজার বিমান বন্দরকে আর্ন্তজাতিক বিমান বন্দরে উন্নতিকরণ প্রকল্প এবং চট্টগ্রাম বন্দর বে-টার্মিনাল প্রকল্পের কথা উল্লেখ করা যায়। এসব মেগা প্রকল্পের মধ্যে পদ্মাসেতু, মেট্রো রেল এবং টানেলের নির্মাণ ২০২২ সালে মধ্যেই স¤পন্ন হবে এবং এগুলো দিয়ে যান চলাচল শুরু হবে। ২০৪১ সাল লাগাদ বাংলাদেশ যে উন্নত দেশে পরিণত হবে এবং এর যে স্বপ্ন আমরা দেখছি, তা কিন্তু মোটেই অবাস্তব এবং অসম্ভব নয়। যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা অপরিহার্য। পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল এবং টানেল চালু হলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার পুরো চিত্রটাই বদলে যাবে এবং আমরা যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন এবং উন্নত এক যুগে প্রবেশ করব।

ফেনীর সোনাগাজী, চট্টগ্রামের মিরসরাই এবং সিতাকুন্ড উপজেলার সাগর তীরবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে গড়ে উঠছে বাংলাদেশের বৃহত্তম ইকোনমিক জোন বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর। প্রায় ৩০,০০০ একর জমি নিয়ে ধাপে ধাপে প্রতিষ্ঠিত হতে যাওয়া এই ইকোনমিক জোনে ইতিমধ্যেই দেশি-বিদেশি উদ্যোক্তারা শিল্প প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছে। এখানে গড়ে উঠছে কৃষিভিত্তিক শিল্প-কারখানা, গার্মেন্ট, টেক্সটাইল, ¯িপনিং, কেমিক্যাল, ফার্মাসিউটিক্যাল, ইলেকট্রনিক, গাড়ি নির্মাণ কারখানাসহ ইস্পাত ও প্রকৌশল খাতের বড় বড় শিল্প কারখানা। এই শিল্প নগরে প্রায় এক হাজার একর জমি নিয়ে গড়ে উঠছে ভারতীয় অর্থনৈতিক জোন, যেখানে ভারতীয় শিল্পপতিরা বিনিয়োগ করবে এবং শিল্প কারখানা স্থাপন করবে। বঙ্গবন্ধু শিল্প নগর হবে আধুনিক বিশ্বের নতুন শিল্পাঞ্চল, যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। চট্টগ্রামের হালিশহরের আনন্দ বাজার এলাকায় পোর্টলিংক রোডের কোল ঘেঁষে বঙ্গোপসাগরের তীরে ২৫০০ একর জমিতে নির্মিত হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প চট্টগ্রাম বন্দর বে-টার্মিনাল। এই বন্দর নির্মাণ স¤পন্ন হলে চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মক্ষমতা বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী এবং বঙ্গোপসাগরের মোহনায় নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মাণ হচ্ছে দেশের প্রথম টানেল, যা দক্ষিণ এশিয়াতেও প্রথম। টানেলের এক পাশে পতেঙ্গা এবং অপরদিকে আনোয়ারা। চার লেন বিশিষ্ট এই টানেল চালু হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কে যোগাযোগের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। চট্টগ্রামের সিতাকুন্ড এবং মিরসরাইসহ পুরো বাংলাদেশের জনগণ তখন আর কক্সবাজার-বান্দরবান-সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন্য চট্টগ্রাম শহর ব্যবহার করবে না। গাড়ি সিতাকুন্ডের ফোজদারহাট দিয়ে পোর্ট লিংক রোড হয়ে টানেল দিয়ে আনোয়ারা হয়ে কক্সবাজার-বান্দরবান-সেন্টমার্টিন যাতায়াত করবে এবং একই পথে তারা ফেরত আসবে।

মহেশখালীতে প্রতিষ্ঠা হচ্ছে ইকোনমিক জোন, কয়লা ভিত্তিক ১২০০ মেঘাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএনজি টার্মিনাল এবং গভীর সমুদ্র বন্দর। বিদেশ থেকে আমদানি করা এলএনজি মহেশখালী হয়েই দেশে প্রবেশ করছে। মহেশখালীর অদূরে নির্মিতব্য গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ স¤পন্ন হলে বড় আকারের জাহাজসমূহ সরাসরি এই গভীর সমুদ্র বন্দরে নোঙর করবে। ফলে এই গভীর সমুদ্র বন্দর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরের মতো ভূমিকা পালন করবে। একইভাবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে নির্মিতব্য ১০২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য ডবলগেজ বিশিষ্ট রেলপথ নির্মাণ শেষ হলে চট্টগ্রাম শহর ও কক্সবাজার শহরের মাঝে যোগাযোগের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে। কক্সবাজারে রয়েছে ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। সরকার কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নতিকরণে প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যার নির্মাণ ২০২৩ সালের মধ্যে শেষ হবে। এই বিমান বন্দরে থাকবে সামুদ্রিক রানওয়ে, যা এর সৌন্দর্য এবং গুরুত্বকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেবে। কক্সবাজার বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নীত হলে বিদেশি পর্যটকরা সরাসরি কক্সবাজারে ল্যান্ড করবে। ফলে কক্সবাজারে বিদেশি পর্যটকদের আগমন বহুগুণে বেড়ে যাবে। বাঁশখালীতে নির্মাণ হচ্ছে কয়লা ভিত্তিক ১২২৪ মেঘাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ এসব প্রকল্প আগামী ৩/৪ বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন স¤পন্ন হবে। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর, কোরিয়ান ইপিজেড, মহেশখালী ইকোনমিক জোন, চায়না ইকোনমিক জোনসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব অর্থনৈতিক জোন গড়ে উঠছে, সেখানে আগামীতে ব্যাপক বিদেশি বিনিয়োগ হবে এবং শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। উৎপাদন, রফতানি, ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থান এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন