দীর্ঘদিন পর ঢাকার ফুটবল মাঠে চমক দেখালো বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের মেয়ে ফুটবলাররা। বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীর মাহেন্দ্রক্ষণে শক্তিশালী ভারতীয় অনূর্ধ্ব-১৯ নারীদলকে হারিয়ে সাফ ফুটবলের শিরোপা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল। বাংলাদেশ দলের মেয়েরা সাফ ফুটবলে শুধু বুধবারের ফাইনালেই নয়, পুরো টুর্নামেন্টেই অনন্য দ্যুতি ও নৈপুণ্য দেখাতে সক্ষম হয়েছে। পুরো টুর্নামেন্টে প্রতিপক্ষের জালে ২০টি গোল দিলেও নিজেদের জালে একটি গোলও হজম করতে হয়নি তাদের। এ কারণেই কমলাপুর শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামের দর্শক গ্যালারিতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। বহু দিন পর ফুটবলে বাংলাদেশ দল নিজ দেশের দর্শকদের উল্লসিত-আনন্দিত বিজয় উপহার দিতে সক্ষম হয়েছে। খেলার শেষ হওয়ার ১০ মিনিট আগে বাংলাদেশ দলের ডিফেন্ডার আনা মুগিনীর দেয়া গোলে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল ২০২১ সালের সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপের বিজয় নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়। দলের অধিনায়ক মারিয়া মান্ডা দর্শকদের ভালো উপভোগ্য ফুটবল উপহার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তারা দর্শনীয়-উপভোগ্য ফুটবল খেলার পাশাপাশি শক্তিশালী ভারতীয় দলকে পরাস্ত করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তীতে এই ট্রফিকে দেশবাসীর প্রতি উৎসর্গ করেছে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ফুটবলাররা। পাঁচটি গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতার ট্রফি জিতেছে শাহেদা আক্তার রিপা। সাফ ফুটবল অনূর্ধ্ব-১৯ চ্যাম্পিয়ন শিরোপা জেতায় আমরা স্বাগতিক চ্যাম্পিয়ন দলকে অভিনন্দন জানাই।
দেশের ক্রীড়াঙ্গণ এখন মূলত ক্রিকেট নির্ভর। জাতীয়ভাবে ক্রিকেটকে যতটা গুরুত্ব দেয়া হয় ফুটবল বা অন্যকোনো খেলার ক্ষেত্রে ততটা নয়। কিন্তু ক্রিকেটে এত বিনিয়োগ, এত তৎপরতা এবং দর্শকদের আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক সময়ে ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে লজ্জাজনক হার ও হোয়াইটওয়াসের সম্মুখীন হতে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয় দলকে। তবে বয়সভিত্তিক ইভেন্টগুলোতে বাংলাদেশের ক্রিকেট ও ফুটবল টিমগুলো বেশ সম্ভাবনাময় হিসেবে বিভিন্ন সময়ে আত্মপ্রকাশ করলেও পরবর্তীতে জাতীয় দল গঠনে সে সম্ভাবনার প্রতিফলন দেখা যায় না। সেখানে নানা রাজনীতি, দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ শোনা যায় যায়। আশির দশকে বাংলাদেশের শিশু-কিশোররা ইউরোপে ডানা কাপ, গোথিয়া কাপে অসাধারণ সাফল্য দেখিয়েছিল। সে সব ক্ষুদে ফুটবলারদের ঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারলে বিশ্ব ফুটবলে বাংলাদেশ এতটা পিছিয়ে থাকত না। চলতি বছর ফিফা র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৬। বছরের পর বছর ধরে এমন অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। অনূর্ধ্ব-১৯ দলের মেয়েরা বুঝিয়ে দিল, সঠিক দিক নির্দেশনা ও প্রত্যয় নিয়ে এগুতে পারলে ফুটবলে বাংলাদেশকে অনেক দূর এগিয়ে নেয়া অসম্ভব নয়। ক্রীড়াঙ্গণে আমাদের জাতীয় দলের ব্যর্থতার দায় অনেকাংশেই বাফুফে, বিসিবির সাথে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।
দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক ফুটবল টুর্নামেন্টগুলোর মধ্যে সাফ ফুটবল অন্যতম। এই টুর্নামেন্টে শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এসব মেয়ে ফুটবলার নিয়ে আমাদের ফুটবল ফেডারেশনের তেমন কোনো পরিকল্পনা, পরিশ্রম ও বিনিয়োগ ছিল না। এই দলে স্থান পাওয়া মেয়েরা নিজেদের ঐকান্তিক ইচ্ছা, সাধনা ও সমন্বিত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে এই সাফল্য ঘরে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ছেলেদের বয়েস ভিত্তিক টিমগুলোতেও অনেক সম্ভাবনাময় ফুটবলার-ক্রিকেটার রয়েছে। তাদের দীর্ঘমেয়াদে সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে পারলে এবং জাতীয় দল গঠনে কর্তৃপক্ষ তাদের বিচক্ষণতা, নিরপেক্ষতা ও মেধার সমন্বয় ঘটাতে পারলে ক্রীড়াঙ্গণে বাংলাদেশের দৈন্য ঘুচানো সম্ভব। বিসিবি ও বাফুফের নেতৃত্বকে দলীয় রাজনীতির মোড়ক থেকে বের করে আনতে হবে। রাজনৈতিক দলবাজি ও অপচয় রোধ করে সারাদেশে ছড়িয়ে থাকা সম্ভাবনাময় ক্রিকেটার-ফুটবলারদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তুলে আনার দিকে অধিক মনোযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ফুটবল দলের মেয়েদের বেশিরভাগই সাধারণ দরিদ্র পরিবারের সন্তান। নানা ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক ও পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে এরা এ পর্যায়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের পরিবারের প্রতি অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে তাদের এবং অন্যদের ক্রীড়াঙ্গণে আগ্রহী করে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশের নারী ফটুবলে দ্যুতি ছড়ানো সম্ভাবনাময় অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সদস্যদের এই সাফল্যের জন্য তাদের আর্থিকভাবে পুরস্কৃত করার পাশাপাশি তারা যেন হারিয়ে না যায়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা জানি, এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই উদার ও সচেতন। বয়সভিত্তিক ফুটবল ও ক্রিকেটের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে আমরা তাঁর বিচক্ষণ নির্দেশনা প্রত্যাশা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন