বাংলাদেশে চালানো এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ কৃষি জমির জৈব উপাদান কমে গেছে। যার ফলে ফসল উৎপাদনে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে হচ্ছে।
এ গবেষণায় বলা হয়েছে, ফসলি জমিতে যেখানে ৫ শতাংশ জৈব উপাদান থাকা দরকার সেখানে দেশের বেশিরভাগ কৃষি জমিতে জৈব উপাদান দুই শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। বাংলাদেশের মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন গবেষণা ইনস্টিটিউট এ গবেষণা করেন। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট আয়তনের ৫৬ শতাংশ জমিতে ফসলের আবাদ হয়। আবাদি জমি, বনভ‚মি, নদী, লেক, বনাঞ্চল মিলিয়ে মোট জমির পরিমাণ এক কোটি ৪৭ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগ জমিতেই জৈব উপাদানের ঘাটতি রয়েছে।
কৃষি জমির অবক্ষয় নিয়ে ২০০০ সালে একটি গবেষণা করা হয়েছিল। এরপর চলতি বছর একই ধরনের আরেকটি গবেষণা চালালে দেখা যায় যে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন অধিদফতরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমীর মোহাম্মদ জাহিদ বলেন, সাধারণত ৫ শতাংশ জৈব পদার্থ থাকা দরকার। কিন্তু আমাদের মতো দেশে যেখানে উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে জৈব পদার্থ বেশি বিয়োজন হয়, তাই আমাদের সাড়ে তিন পার্সেন্ট থাকলেও হয়। আমরা দেখেছি যে, জমিতে এ পরিমাণ ২ শতাংশের নিচে এমনকি কোথাও কোথাও ১ শতাংশের নিচে রয়েছে।
জৈব উপাদানকে মাটির প্রাণ বলে অভিহিত করেন কৃষিবিদ এবং বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, মাটিতে যেসব পচনশীল দ্রব্য বা উপাদান থাকে যা বেশি পরিমাণে গাছ ও উদ্ভিদ শোষণ করে থাকে সেগুলোকেই জৈব উপাদান বলা হয়। তবে এর মধ্যে অনেক ক্ষুদ্র অণু উপাদানও রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নানা ধরনের অণুজীব।
শের-এ-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. শারমিন সুলতানা বলেন, জৈব উপাদানের উপর মাটির জৈব ও রাসায়নিক গঠন নির্ভর করে এবং এটি মাটির পরিবর্তনের সাথেও জড়িত। জৈব পদার্থ বেড়ে গেলে মাটির টেক্সচার, স্ট্রাকচার ভালো হয়। মাইক্রো অর্গানিজম অ্যাক্টিভ হয় যেটা গাছের জন্য জরুরি। তবে জমির উপরিভাগের মাটি কেটে ফেলা এবং ফসল উৎপাদনে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের মতো নানা কারণে এটি কমে যেতে পারে বলে মনে করেন ড. শারমিন সুলতানা। তিনি বলেন, আবহাওয়া উষ্ণ হলে মাইক্রোঅর্গানিজম সক্রিয় হয়, জৈব উপাদানকে ভেঙে ফেলে। আবার জমিতে যে পরিমাণ জৈবসার দেয়ার কথা, সেটি দেয়া হয় না।
আগে ধানের খর জমিতে পচতে দেয়া হলেও এখনো সেই সুযোগ দেয় না কৃষকরা। শুরু হয় নতুন ফসল বোনা।
এছাড়া নিবিড় চাষাবাদ পদ্ধতিতে একই জমিতে কোন ধরনের বিরতি না দিয়ে বারবার চাষ করাটাও জৈব উপাদান কমাতে ভ‚মিকা রাখে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জৈব উপাদান মাটির উর্বরতা ধরে রাখে।
পাশাপাশি, মাটির গুণাগুণ, চাষাবাদ সহজ করা, পানির স্তর ধরে রাখা, বায়ু চলাচলে সহায়তা করে এটি; যা ফসল উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে।
এ কারণেই মাটিতে জৈব উপাদানের পরিমাণ কমে গেলে তা ফসল উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে বলে জানাচ্ছেন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আমীর মোহাম্মদ জাহিদ। তিনি বলেন, জৈব উপাদান শুধু পুষ্টি উপাদানের ভাÐার তাই না, এটি পরিমিতভাবে থাকলে অন্যান্য উপাদান যেগুলো উর্বরতার নিয়ামক সেগুলোর জন্য সহায়ক হয়। মাটিতে এ উপাদান কমলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে। এছাড়া হেক্টর প্রতি যে পরিমাণ ফসল হয় সেটির উৎপাদনও কমে যাবে। শুধু বেশি ফলন হলেই হবে না পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাদ্য আমরা চাই। জৈব উপাদান নির্ধারণ করে যে ফসলের পুষ্টিগুণ কতটা ভালো হবে।
পুষ্টিবিদরা বলছেন, মাটিতে জৈব উপাদানের ঘাটতি হলে মানুষের উপরও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। কারণ মাটির গুণাগুণ কমে গেলে ফসল উৎপাদন করতে গিয়ে বেশি পরিমাণে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়। এর ফলে ফসলের খাদ্যগুণ যেমন কমে যাচ্ছে, তেমনি এগুলো খাবারের মাধ্যমে মানুষের দেহেও প্রবেশ করছে।
বাংলাদেশ ডায়েট কাউন্সিলের প্রিন্সিপাল নিউট্রিশনিস্ট সৈয়দা শারমিন আক্তার বলেন, দেখতে বড়, পচেও না, অনেক দিন থাকছে, কিন্তু পুষ্টিগুণ কম। খেতেও আর আগের মতো স্বাদ-গন্ধ নেই। এখন অনেক নতুন নতুন রোগ হচ্ছে। আগে যেগুলো ছিল না। তার মানে কি? মানে হচ্ছে পুষ্টি উপাদান নষ্ট হচ্ছে, যার কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপুল জনসংখ্যার বাংলাদেশে ফসল উৎপাদন কমানো সম্ভব নয়, ফলে নিষিদ্ধ করা সম্ভব নয় ফসল উৎপাদনে রাসায়নিক সারের ব্যবহার। তবে তাদের মতে, মাটির জৈব উপাদান রক্ষায় রাসায়নিক সারের পরিমিত ব্যবহার এবং জমিতে জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন