বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আদিগন্ত

নদী বাঁচাও, বাঁচাও দেশ

প্রকাশের সময় : ৩ নভেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এ কে এম শাহাবুদ্দিন জহর

বাংলাদেশকে বলা হয় সোনার বাংলা। মোঘলদের সরকারি কাগজে বাংলাদেশকে উল্লেখ করা হতো ‘সমুদয় মানবজাতির স্বর্গতুল্য বঙ্গভূমি’ নামে। এই বাংলার সম্পদ হস্তগত করেই বৃটিশ বেনিয়ারা সমগ্র ভারত দখল করেছিল। এই যে বাংলার এত সম্পদ, এত সুনাম, এত জনবল এর ভিত্তি কিন্তু বাংলাদেশের নদনদী। বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। পশ্চিম- উত্তর-পূর্ব তিনদিক থেকেই অসংখ্য নদনদী বাংলাদেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দক্ষিণে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এসব নদনদীর কারণেই বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। মা যেমন বুকের দুধের প্রবাহ দিয়ে সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখে, তেমনি বাংলাদেশের নদনদী বুকের দুগ্ধ-সম জলধারা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের সন্তান, এদেশের জনগণকে।
নদনদী বর্ষার পানিতে ভরাট হয়ে প্লাবিত করে শস্য ক্ষেত্র এবং তা হয়ে উঠে নরম পলিযুক্ত ও উর্বর। কোন কৃ ত্রিম বাঁধ ছাড়াই নদনদীর পানি জমিতে সেচ করে উৎপনড়ব করে কৃষকেরা গোলা ভরা ধান, সোনালী আঁশ পাট ও অন্যান্য ফসল। নদনদীগুলো বাংলাদেশের মানুষের মুখে তুলে দেয় সর্বোত্তম আমিষ জাতীয় খাদ্য- সুস্বাদু হরেক রকমের মাছ এবং মাছের রাজা ইলিশ। বাংলাদেশের নদনদী সরবরাহ করে সর্ব কাজের জন্য প্রয়োজনীয় মিঠা পানি। এই নদী বাঙ্গালীকে করেছে সাতারু জাতি। পরিবহনের সর্বোত্তম ব্যবস্থা যে নৌপথ, আমাদের নদনদী তা দিয়েছে সম্পূর্ণ বিনা খরচে এবং সরল পথে। বাংলাদেশের দক্ষিণ অংশের নদনদীগুলো পদ্মার মিঠা পানির প্রবাহ লবণাক্ততার সাথে মিশে তৈরি করেছে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। বাংলাদেশের নদনদী উজান থেকে বালি ও মাটি বহন করে নিয়ে বঙ্গোপসাগরে μমাগত সৃষ্টি করে চলেছে নতুন নতুন চর, দ্বীপ ও স্থলভূমি। বিশ্বের যে কোন নদনদীর মতো বাংলাদেশের নদনদীতেও বাঁধ দিয়ে তৈরি করা যায় পরিবেশবান্ধব জলবিদ্যুৎ ও শুষ্ক মৌসুমে সেচের ব্যবস্থা। নদনদীগুলো ছোট এই দেশটিতে দেয় প্রাকৃতিক সুরক্ষা। এগুলো আমাদের প্রাকৃতিক রক্ষা কবজের মতো। এই নদনদীর সহায়তা নিয়েই বাংলার বীর ঈসা খাঁ পরাস্ত করেছিল মোঘল শ্রেষ্ঠ আকবরের সেনাবাহিনীকে।
বাংলাদেশের নদনদী বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যম-িত করেছে। বাংলার কবি জীবনানন্দ লিখেছেন, ‘আবার আসিব ফিরে, ধানসিঁড়িটির তীরে’, মহাকবি মাইকেল মধুসূদন আর এক নদী কপোতাক্ষ সম্পর্কে বলেছেন, ‘বহু দেশ দেখিয়াছি বহু নদ দলে কিন্তু এ তৃষ্ণার সুধা মিটে কার জলে।’ বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অসংখ্য সাহিত্যকর্ম রচনা করেছেন পদ্মা নদীতে, বোটে বসে। তিনি তার ‘মানসী’ কবিতায় বলেছেন, ‘পদ্মা শ্রান্ত রূপসীর মতো বিস্তীর্ণ অঞ্চলে শুয়ে আছে।’ নদী বাংলাদেশের মানুষকে দিয়েছে সাহিত্য ও সংগীতে প্রেরণা।
কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের এই যে প্রাণ, এই যে হৃদপি-, এত এত সেবা ও সুখদানকারী নদ-নদীগুলো আজ দানবের পদাঘাতে ভূলুণ্ঠিত ও মৃতপ্রায়। কারণ এই নদনদীগুলো সৃষ্টি হয়েছে হিমালয় অঞ্চলে। উৎপত্তি স্থল থেকে প্রমে এগুলো প্রবেশ করেছে ভারতে। ভারত এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নদ-নদীগুলোতে একের পর এক বাঁধ দিতে দিতে এখন প্রায় সবগুলো নদীতেই বাঁধ দিয়ে ফেলেছে। বাকিগুলোতেও দেওয়ার প্রμিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতের বাঁধগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পদ্মার উজানে ফারাক্কা বাঁধ, তিস্তার উপরে গজল ডোবা বাঁধ এবং বরাক নদীর উপরে টিপাইমুখ বাঁধ। ফলে বাংলাদেশের মানুষ এক সময়ের জল থৈ থৈ নদনদীগুলোর উপকার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়। ভারত এমনকি বর্ষা মৌসুমের পানি থেকেও বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার জন্য হাতে নিয়েছে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের পানিকে ভারত তার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে মরুসদৃশ এলাকায় নিয়ে সেখানে সবুজের সমারোহ ঘটাবে এবং বাংলাদেশকে করবে ধূধূ বালুকাময় মরু প্রান্তর। ভারতের এক রাজ্য অন্য রাজ্যে পানি দিতে অনীহা প্রকাশ করে থাকে। এক্ষেত্রে পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমাঞ্চলে পানি নিতে ভারত সরকার আগ্রহী যে একেবারেই না তা নিশ্চিত। তাদের সব আয়োজন শুধুমাত্র বাংলাদেশের নদনদীর অবশিষ্ট পানিও লুণ্ঠন করা। তবে বন্যার সময়ে তারা সবগুলো বাঁধের পানি বাংলাদেশের দিকে ছুড়ে দেবে। যাতে তারা বন্যার হাত থেকে রক্ষা পায় এবং বাংলাদেশ বন্যার ছোবলে ক্ষতবিক্ষত হয়।
বাংলাদেশের এই দুর্দশা দেখে সারাবিশ্ব ব্যথিত। ইউনেস্কো তার রিপোর্টে ফারাক্কা বাঁধ থেকে মিঠা পানি ছেড়ে দিয়ে সুন্দরবনকে রক্ষার তাগিদ দিয়েছে। অথচ দুঃখের বিষয় আমরা জানা- অজানা নেশায় ভারতের উপরে এ ব্যাপারে কোনো চাপতো প্রয়োগ করছিই না বরং ভারতের ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প ও অন্যান্য প্রকল্প দিয়ে সুন্দরবনের ধ্বংস সাধনে উঠেপড়ে লেগেছি। ভারতের তিস্তা নদীর উপর অধিকার অতি সামান্য। কারণ এ নদী ভারতের একটিমাত্র পার্বত্য জেলা জলপাইগুড়ির উপর দিয়ে প্রবাহিত। পক্ষান্তরে তিস্তা বাংলাদেশের সর্ব উত্তর থেকে যাত্রা শুরু করে এর পানি যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনা প্রভৃতি নদনদীর উপর দিয়ে সর্ব দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। অথচ আশ্চর্যের বিষয় ভারত তিস্তার সমস্ত পানি একাকী ভোগ করছে এবং বাংলাদেশের মানুষের পানির জন্য আহাজারির দিকে কর্ণপাতও করছে না। সে একদিকে কেন্দ্র ও রাজ্যের ইচ্ছা ও অনিচ্ছা নিয়ে নাটক করছে, অন্যদিকে ছলেবলে, কৌশলে বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্য, কূটনৈতিক, ট্রানজিট, সীমান্তের বিদ্রোহী দমনের সহায়তাসহ সব রকমের সুবিধা পেয়েই চলছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে ফায়দা লুটতে ভারত সব সময়ই সচেষ্ট। ভারত স্থলবেষ্টিত নেপাল থেকে সুবিধা আদায়ের জন্য কখনো কখনো তার পণ্য পরিবহনে বাঁধার সৃষ্টি করে। পাকিস্তানের সিন্ধু ও তার উপনদীগুলির পানির উপরে আরও বেশি অধিকার লাভের জন্য সে পাঁয়তারা করছে। কিন্তু পেরে উঠতে পারছে না পাকিস্তানের শক্ত অবস্থানের কারণে। পাকিস্তান যদি ভারতের পানি আগ্রাসন রুখতে পারে, বাংলাদেশ কেন পারবে না?
বাংলাদেশের উচিত বাংলাদেশের নদনদী রক্ষার ইস্যুটি আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থাপন করা। পদ্মা, তিস্তাসহ সকল নদনদীতে ভারত সীমান্ত ঘেঁষে বাঁধ নির্মাণ করা যাতে বন্যার সময়ে পানি আটকিয়ে দিয়ে অন্তত বন্যার হাত থেকে দেশকে রক্ষা করা যায়। বাংলাদেশকে তার স্বার্থ রক্ষার্থে আনুগত্য নীতির পরিবর্তে অবশ্যই মোকাবিলার নীতি অনুসরণ করতে হবে। সরকারকে বুঝতে হবে রাজনীতিতে কেউই চিরকাল শত্রু বা মিত্র থাকে না। পরাμমশালী প্রতিপক্ষের হাত থেকে জাতিকে রক্ষার জন্য ভুক্তভোগী দেশগুলো নিয়ে জোট গঠন করে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের উৎপীড়ন ঠেকানো সম্ভব।
লেখক : কলামিস্ট ও শিক্ষাবিদ

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Ggcgc ৭ জানুয়ারি, ২০২০, ৮:২৮ এএম says : 0
প্রভু বাচলেই যতেষ্ট নিজের লোক মোরুক তাতে কি যায় আসে? কোন এক বন্ধুর নিয়ে এরা বাচতে চায়৷
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন