শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সারা বাংলার খবর

থানায় স্বামীকে নির্যাতনের পর স্ত্রীকে ধর্ষণের হুমকির অভিযোগ

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, ৫:২৮ পিএম

রাজবাড়ী সদর থানায় পুলিশের কাছ থেকে ধর্ষণের হুমকি পাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন এক নারী। নারীর অভিযোগ, সদর থানায় আটকে রেখে তার স্বামীকে নির্যাতন করেছে পুলিশ। এ সময় তাকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনায় তিনি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের আইজিপিস কমপ্লেইন সেলে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দিয়েছেন।

অভিযোগকারী নারীর নাম তাপসী রাবেয়া। তার বাড়ি রাজবাড়ী সদরের বানিবহ ইউনিয়নে। তিনি রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন।

তাপসীর স্বামী মেহেদী হাসান। তিনিও রাজধানীর একই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন। বছর দু-এক আগে ভালোবেসে তাপসীকে বিয়ে করেন যশোরের ছেলে মেহেদী।

ঘটনার শুরু একটি হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে। রাজবাড়ীর বানিবহ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ছিলেন আব্দুল লতিফ মিয়া (৫৭)। তিনি এবারের ইউপি নির্বাচনে দল থেকে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। গত বছরের ১১ নভেম্বর খুন হন লতিফ। লতিফের প্রতিবেশী তাপসী। সেই সুবাদে লতিফকে নির্বাচনী কাজে সহায়তা করছিলেন মেহেদী।

নিহত ব্যক্তির স্বজন ও স্থানীয় লোকজনের ভাষ্যমতে, আবদুল লতিফ এলাকায় জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি মাঝেমধ্যে হত্যার হুমকি পেতেন। গত ১১ নভেম্বর রাতে বানিবহ বাজারে নির্বাচনী কাজ শেষে তিনি মোটরসাইকেলে করে মেহেদীকে তার বাড়িতে নামিয়ে দিতে যান। দিবাগত রাত পৌনে ১২টার দিকে হঠাৎ পুরো এলাকায় বিদ্যুৎ চলে যায়। মেহেদীকে তার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যাওয়ার পরপরই আবদুল লতিফকে সামনে থেকে দুটি গুলি করে দুর্বৃত্তরা। এ সময় তিনি মোটরসাইকেল নিয়ে এগোতে থাকলে তাকে পেছন থেকে আরও তিনটি গুলি করা হয়। উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার সময় পথে তার মৃত্যু হয়।

মৃত্যুর আগে আবদুল লতিফ তার ওপর হামলাকারী হিসেবে মোর্শেদ, সীমান্ত, মনির, লিটন, জাকারিয়া, হোসেন, মুন্সীসহ কয়েকজনের নাম বলে যান। তার এ-সংক্রান্ত কথা মুঠোফোনে রেকর্ড করা আছে।

মোর্শেদকে প্রধান আসামি করে কয়েকজনের নামে রাজবাড়ী সদর থানায় হত্যা মামলা করেন আবদুল লতিফের স্ত্রী শেফালী আক্তার।

স্বামীর মৃত্যুর পর শেফালী বানিবহ ইউপিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে এখন দায়িত্ব পালন করছেন।

প্রধান আসামি মোর্শেদের বাবার নাম হাবিবুর রহমান। তিনি বানিবহ ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপির নেতা।

এখন পর্যন্ত মামলার এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মামলার তদন্ত এখনো চলছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। তদন্তের সূত্র ধরে আবদুল লতিফের সহযোগী মেহেদীকে আটক করার কথা বলছে পুলিশ।

তাপসী বলেন, হত্যাকাণ্ডের সময় মেহেদী বাড়ির ভেতরে ছিলেন। চিৎকার শুনে শুরুতে তাদের ধারণা হয়েছিল, বাড়িতে হয়তো ডাকাত পড়েছে। পরে বাইরে বেরিয়ে দেখা যায়, রক্তাক্ত আবদুল লতিফকে ধরাধরি করে তাদের বাড়ির ভেতরে আনছেন লোকজন।

হত্যাকাণ্ডের এক সপ্তাহ পর এক রাতে রাজবাড়ী সদর থানার ওসি শাহাদত হোসেনের নেতৃত্বে একদল পুলিশ তাদের বাড়িতে আসে বলে জানান তাপসী। তিনি বলেন, বাড়িতে এসে মেহেদীর সঙ্গে কথা বলতে চান পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) হিরণ কুমার বিশ্বাস। পরে মেহেদীকে সঙ্গে নিয়ে যায় পুলিশ। ওই রাতে মেহেদী আর বাড়িতে ফেরেননি। পরদিন রাজবাড়ী সদর থানা, পুলিশ সুপারের কার্যালয় ও অন্যান্য আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার অফিসে স্বামীর খোঁজ করেন তাপসী।

তাপসী বলেন, ‘থানায় গিয়ে দেখি, মেহেদীকে বেঁধে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে পুলিশ। পেটাতে পেটাতে তারা মেহেদীকে বলছে, স্বীকার কর যে তুই লতিফ চেয়ারম্যানকে গুলি করেছিস।’

তাপসী বলেন, থানায় গেলে আমার মুঠোফোন কেড়ে নেয় পুলিশ। আমাকে ও মেহেদীকে পাশাপাশি দুটো কক্ষে আটকে রাখা হয়। মাঝে কাচের দেয়াল ছিল। আমি সব দেখতে ও শুনতে পাচ্ছিলাম। তাপসীর অভিযোগ, আবদুল লতিফ হত্যার ঘটনায় মেহেদীকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে পুলিশ।

তাপসী বলেন, পুলিশ মেহেদীকে মারধর করছিল আর তাকে বলছিল, “অস্ত্র কোথায় আছে বল? তোর বউ এখানে আছে। ওর নামেও মামলা দেব। স্বীকার কর যে তুই খুন করেছিস।” মারতে মারতে মেহেদীকে আমার কাছে নিয়ে আসে। মেহেদী আমাকে বলে, “আমিতো কিছু করিনি।”’

তাপসীর ভাষ্য, পুলিশ মেহেদীর দাড়ি ধরে জোরে টান মারে। তার নখ তুলে ফেলে। ছয় থেকে সাতজন পুলিশ মিলে বুট জুতা দিয়ে মেহেদীকে মেঝের সঙ্গে চেপে ধরে। পুরো সময় মেহেদীর চোখ বাঁধা ছিল। মাঝরাতে পুলিশ বলে, মেহেদীকে ক্রসফায়ারে দেওয়া হবে। তাপসীর সামনে দিয়ে তার স্বামীকে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর মেহেদীকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়।

তাপসী বলেন, ‘ওই রাতে মনে হয়েছিল, আমার উদ্বিগ্ন মা-বাবা হয়তো আমাকে বারবার ফোন করছেন। কিন্তু ফোনে এপাশ থেকে মিথ্যা কথা বলা হচ্ছিল। বলা হচ্ছিল, তাপসী ও তার স্বামী ঢাকায় চলে গেছে। অথচ, তখন আমরা থানাতেই আটক ছিলাম।’

তাপসীর ভাষ্য, তাকে যে কক্ষে আটকে রাখা হয়েছিল, সেখানে ভোর চারটার দিকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সালাউদ্দীন, ওসি শাহাদত হোসেন, গোয়েন্দা শাখার পরিদর্শক প্রাণবন্ধু বিশ্বাস, এসআই হিরণ কুমার বিশ্বাস প্রবেশ করেন।

তাপসী বলেন, ‘ঢাকা থেকে আরেক পুলিশ সদস্য এসেছিলেন। তিনি আমার গা ঘেঁষে বসেন। অন্যরা আমাকে ঘিরে বসেন। আমার, মেহেদী ও আমাদের সন্তানের নামে তারা আজেবাজে কথা বলছিলেন। এমনকি আমার বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক রয়েছে দাবি করে তারা নানা অশ্লীল মন্তব্য করেন।’

এ সময় পুলিশ সদস্যরা হাত দিয়ে নানা অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করছিলেন বলে অভিযোগ তাপসীর। তিনি বলেন, ‘আমি বসে ছিলাম। আমাকে উঠে দাঁড়াতে বলা হয়। জানাই, আমি দুই মাসের গর্ভবতী। এ কথা শুনে একজন ছাড়া পুলিশের অন্য সদস্যরা কক্ষটি থেকে চলে যান। কিন্তু আমার গা ঘেঁষে যিনি বসেছিলেন, তিনি থেকেই যান। তাকে ইঙ্গিত করে পুলিশের অন্য সদস্যরা বলেন, “ওকে আপনার দায়িত্বে দিয়ে গেলাম।” এরপর তারা দরজা লাগিয়ে চলে যান।’

তাপসী আরও বলেন, ‘অন্যরা চলে গেলে ওই পুলিশ সদস্য আমাকে বলেন, “আমারে চিনস?” তার হাতে দুটো মোবাইল ছিল। তিনি বলেন, “কিছু দেখবি?” আমি বুঝতে পারিনি। আমি বলি, কী দেখব? তখন আমাকে উনি বলেন, “তুই কি রেপ হইতে চাস?” এ কথা শুনে আমি তার হাতে-পায়ে ধরি। আমার ক্ষতি না করতে অনুরোধ করি। তখন ওই পুলিশ সদস্য আমাকে একটা চড় মেরে বেরিয়ে যান।’

তাপসী বলেন, এভাবেই রাতটা কেটে যায়। পরদিন সকাল আটটার দিকে তার বাবা থানায় আসেন। তখনো তার ও মেহেদীর অবস্থান নিয়ে মিথ্যা তথ্য দেওয়া হচ্ছিল। একপর্যায়ে তিনি জানালা দিয়ে তার বাবাকে ডাকেন। এরপর সাদা কাগজে মুচলেকা দিয়ে তিনি তার বাবার সঙ্গে বাড়িতে ফেরেন। আর মেহেদীকে পাঠানো হয় কারাগারে।

তাপসী যেসব অভিযোগ করেছেন, সেগুলোর সঙ্গে আইজিপিস কমপ্লেইন সেলে দেওয়া তার অভিযোগের মিল রয়েছে। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এই সেলে পুলিশ সদস্যদের যেকোনো অপেশাদার ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অভিযোগ করতে পারেন জনগণ।

রাজবাড়ী জেলা পুলিশ সুপার এম এম শাকিলুজ্জামান বলেন, সবদিক বিবেচনা করে আবদুল লতিফ হত্যা মামলা তদন্ত করতে হচ্ছে। মারা যাওয়ার আগে দেওয়া তার জবানবন্দিতে মেহেদীর নাম নেই ঠিকই, কিন্তু তদন্তে তার সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে। তাই তাকে আটক করা হয়েছে। মেহেদীর স্ত্রীকে থানায় আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ পুরোপুরি অসত্য। তাপসীকে আটকে রাখা, ধর্ষণের হুমকি ও অশ্লীল মন্তব্য করার কথা অস্বীকার করেন পুলিশ সদস্য প্রাণবন্ধু বিশ্বাস ও হিরণ কুমার বিশ্বাস।

ওসি শাহাদত হোসেন বলেন, হত্যাকাণ্ডের আগে আবদুল লতিফের সঙ্গে তাপসীর বাগ্‌বিতণ্ডা হয়েছিল। তিনি সবার সামনে বলেছিলেন, লতিফ চেয়ারম্যানকে দেখে নেবেন।

এ কারণে একজন নারীকে থানায় আটকে রেখে হয়রানি-নির্যাতন করা যায় কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ওসি শাহাদত হোসেন বলেন, তাপসীকে থানায় আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগ সত্য নয়। তাকে অশ্লীল কোনো মন্তব্যও করা হয়নি। তাপসী তার স্বামীকে ছাড়া থানা থেকে যেতে চাননি। তাই তিনি রাতে থানায় ছিলেন।

সামগ্রিক বিষয়ে তাপসী অভিযোগ করে বলেন, আবদুল লতিফকে খুন করলে যারা লাভবান হবেন, তাদের কাউকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। হত্যাকাণ্ডের সময় বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল কার নির্দেশে, এ প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা। এ হত্যা নিয়ে একটি অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়েছে। সেটি যাচাই করতে তদন্ত কর্মকর্তাদের কোনো আগ্রহ নেই। উল্টো আমাকে ও আমার স্বামীকে থানায় আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়েছে। এ ঘটনায় আমি আনুষ্ঠানিকভাবে আইজিপিস কমপ্লেইন সেলে অভিযোগ জমা দিয়েছি। আমি দায়ীদের বিচার চাই।’

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন