শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

ভোজ্যতেল উধাও

বাণিজ্যমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রী মুখোমুখি দাম নিয়ন্ত্রণে তিন আইনজীবীর হাইকোর্টে রিট সারাদেশের মুদি দোকানে সয়াবিনের সরবরাহ নেই বেশি দামের আশায় কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করা হয়েছে

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৭ মার্চ, ২০২২, ১২:০১ এএম

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ২ মার্চ ঘোষণা দেন ‘ভোজ্যতেলের দাম বাড়বে না; ব্যবসায়ীদের দাম বৃদ্ধির দাবি সরকার নাকচ করে দিয়েছে’। খবরটি টিভিতে ফলাও করে প্রচার করা হয়। এ খবর প্রচারের পরই ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট বাজারে সয়াবিন তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। বাজারে তেলের সঙ্কট সৃষ্টি হওয়ায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সয়াবিন তেল হাওয়া হয়ে যায়। ভোজ্যতেল ব্যবসা করেন এমন প্রভাবশালী অসাধু ব্যবসায়ীরা সরকারের নির্দেশনা উপেক্ষা করেই সিন্ডিকেট করে সরবরাহ কার্যত বন্ধ করে দিয়েছে। গতকাল রাজধানীর বাজারগুলো ঘুরে দেখা গেছে কিছু এলাকায় বেশি দামে ভোজ্যতেল পাওয়া গেলেও অনেক এলাকায় দোকানে ভোজ্যতেল নেই। এ অবস্থায় গতকাল ভোজ্য সয়াবিন তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে মনিটরিং সেল গঠন এবং নীতিমালা তৈরি করতে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের তিনজন আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনির হোসেন, অ্যাডভোকেট সৈয়দ মহিদুল কবীর ও অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ উল্লাহ এ রিট দায়ের করেন। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি এস এম মনিরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চে রিট আবেদনটির ওপর শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, বাজার মূলত সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। প্রতিটি পণ্যের মূল্য হু হু করে বাড়ছে। সরকারের তদারকি, ভ্রাম্যমাণ আদালত কোনো কিছুতেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। গত ৫ মার্চ যাত্রাবাড়ীর ফারুক রোডে আবুল খায়ের ট্রেডার্স নামের একটি দোকান থেকে ৬০ ব্যারেল তেল উদ্ধার করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, আবুল খায়ের ট্রেডার্সের মতো শত শত অসাধু ব্যবসায়ী রয়েছেন তারা ভোজ্যতেল গুদামজাত করে রেখে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কটের সৃষ্টি করছেন। এই অসাধু ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগই সরকারি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় তাদের বিরুদ্ধে তেমন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। তবে বিভিন্ন জেলায় ও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় লোক দেখানো অভিযান চালাচ্ছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

মূলত পবিত্র রমজান মাস আসন্ন হওয়ায় বাজারে বেশ কিছুদিন ধরে ভোজ্যতেলের বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দামামা এবং আসন্ন রমজান ঘিরে অসাধু ব্যবসায়ীরা তেল মজুতের মাধ্যমে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করছে। তাদের অতিমুনাফার লোভে তেলের দামও বাড়ছে হু হু করে। ভুক্তোভোগীরা বলছেন, বাজারে সরকারের তেমন নজরদারি নেই। মাঝে-মধ্যে কোথাও কোথাও ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে দেখে দেখে দু-চারজনের জরিমানা করে মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হয়। বাস্তবে কোথাও তদারকি নেই। এর মধ্যে ৫ মার্চ কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক অসৎ ব্যবসায়ীদের উস্কে দিয়ে বলেছেন, ভোজ্যতেলের দাম কিছুটা না বাড়লে কেউ বিদেশ থেকে তেল আমদানি করবে না। তিনি ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। অথচ এর দু’দিন আগে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সরকারের অবস্থান জানিয়ে বলেছেন, কোনোভাবেই সয়াবিনের দাম বাড়ানো যাবে না।

সরকারের দুই মন্ত্রীর বিপরীতমুখী এই বক্তব্যের পর গতকাল মুখ খুলেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, তেল, পেঁয়াজসহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে একটাই কারণ আওয়ামী লীগের মন্ত্রী এবং তাদের নেতাদের দুর্নীতি। তারা দুর্নীতি করে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। সয়াবিন তেলের দাম বাড়ছে কেন? সয়াবিন তেলের যারা ব্যবসা করে তারা বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের ব্যবসায়ী।

শনির আখড়ার মসজিদ রোডের মনির হোসেনের মুদি দোকানে সব সময় শতাধিক সয়াবিন তেলের বোতল দেখা যেত। তিন দিন ধরে তার দোকানে সয়াবিন তেলের কোনো বোতল নেই। জানতে চাইলে মনির হোসেন বলেন, কোম্পানি সরবরাহ না করলে আমরা তেল রাখব কেমন করে? তেল দেয় না বলে আমরা বিক্রি করতে পারছি না। শুধু মনিরের দোকান নয়, রাজধানীর বেশ কয়েকটি এলাকা ঘুরে একই চিত্র দেখা যায়। ব্যবসায়ীরা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাত দেখিয়ে দেশি রিফাইনারি কোম্পানিগুলো হঠাৎ করেই তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। কোনো কোনো কোম্পানী সয়াবিন তেল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। কোম্পানি থেকে ডিলার ও পাইকারি বাজারে সরবরাহ না থাকায় খুচরা বাজারে ভোজ্যতেল পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা জানান, মূলত বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্য টিভিতে প্রচারের পরের দিন থেকে তেল সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রতি লিটার সয়াবিন গড়ে ১৫ থেকে ২০ টাকা বেশি দরে বিক্রি হয়েছে। হাতিরপুল ও নিউমার্কেটে প্রতি লিটার ১৮৫ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হয়। যাত্রাবাড়ী, ফকিরেরপুল বাজারে একই চিত্র। দোকানের সেলফে তেল না থাকা প্রসঙ্গে নিউমার্কেটের হোসেন স্টোরের বিক্রয়কর্মী মো. আরিফ বলেন, কোম্পানিগুলো চাহিদামতো তেল দিচ্ছে না, তাই দোকানে তেল নেই। মূলত তেল লুকিয়ে রাখা হয়েছে বাড়তি দামে বিক্রির আশায়। ফলে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে সয়াবিন তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে মনিটরিং সেল গঠন এবং নীতিমালা তৈরি করতে হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হয়েছে। এই রিটে বাণিজ্য সচিব, ভোক্তা অধিকার কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের রিটে বিবাদী করা হয়েছে।
এর আগে গত ৩ মার্চ সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনেন ৩ আইনজীবী। তারা সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানো নিয়ে একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন আদালতের নজরে আনেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী সয়াবিন তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দিয়েছেন। ২ মার্চ বাজারে ক্রেতাদের কাছ থেকে এক লিটার খোলা সয়াবিনের দাম রাখা হয়েছে ১৭৫ টাকা। অথচ সরকার এক লিটার খোলা সয়াবিনের দাম ১৪৩ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। আদালত আইনজীবীদের যথাযথ প্রক্রিয়ায় রিট করার পরামর্শ দেন। সে অনুযায়ী রিট করেছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা।

এর আগে গত বুধবার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি সাংবাদিকদের জানান, তার মন্ত্রণালয়ের কাছে তথ্য আছে, মধ্যস্বত্বভোগীরা ভোজ্যতেলের মজুত গড়েছেন। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকারসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হবে।

বাণিজ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের বিপরীতে বক্তব্য দেন কৃষিমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক। ৫ মার্চ তিনি বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও কোভিড পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে। ভোজ্যতেল আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয়। এ অবস্থায় তেলের দাম কিছুটা না বাড়ালে কেউ আমদানি করবে বলে মনে হয় না। তবে সরকার কঠোরভাবে বাজার মনিটর করছে। পর্যাপ্ত পরিমাণ ভোজ্যতেল আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, গত দুই বছরে কোভিডের সময় উন্নত বিশ্বের কৃষকরা আবাদ করেননি, মাঠে নামেননি, শ্রমিক খনিতে নামেননি। আবার ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব রয়েছে। এসবের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে।
তারও আগে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে রিফাইনারি কোম্পানিগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত ফেব্রুয়ারিতে প্রতি লিটারে খোলা সয়াবিনের দাম ৭ টাকা এবং বোতলজাত তেলের দাম লিটারপ্রতি ৮ টাকা বাড়ানো হয়। এরপর আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে তারা ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে প্রতি লিটারে আরো ১২ টাকা বাড়ানের প্রস্তাব করে। বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে তেলের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নাকচ করে দেয়া হয়।

তবে গত ৬ ফেব্রুয়ারি ব্যবসায়ীদের কথা বিবেচনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতি লিটার তেলে ৮ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সে সময় প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনের দর নির্ধারণ করা হয় ১৪৩ টাকা, বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন ১৬৮ টাকা ও বোতলজাত পাঁচ লিটারের সয়াবিন ৭৯৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এখন বাজার থেকে তেল উধাও হয়ে গেছে। তবে এফবিসিসিআই ভোজ্যতেলসহ পণ্যমূল্য বৃদ্ধির বিষয় আলোচনার লক্ষ্যে আজ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করবে বলে জানা গেছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (6)
Robiul Alam ৭ মার্চ, ২০২২, ৪:০৩ এএম says : 0
বাংলাদেশে এমন সময় আসবে ভাত ছাড়া অন্য কিছু খাওয়া ছাড়ে দিতে হবে।
Total Reply(0)
Abdul Awal ৭ মার্চ, ২০২২, ৪:০৪ এএম says : 0
কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ভোক্তাদের হয়রানি আর অর্থনৈতিক শোষণ করা হচ্ছে।সঠিক প্রতিকার চাই।
Total Reply(0)
Tanmay Biswas ৭ মার্চ, ২০২২, ৪:০৪ এএম says : 0
তেলের দাম বাড়লে মানুষ তেল কম খাবে। অতিরিক্ত তেল খেলে যেসব রোগের ঝুঁকি থাকে সেগুলো কমবে এখন৷ তাই বলি সব সময় নেতিবাচক চিন্তা না করে মাঝে মধ্যে ইতিবাচক চিন্তাও করুন৷
Total Reply(0)
Goutam Bous ৭ মার্চ, ২০২২, ৪:০৫ এএম says : 0
ব্যবসায়ীরা সরকারকে ভুল বুঝিয়ে কারসাজি করে তাই খাদ্য পনের বাজার বিদেশিদের সাথে উন্মুক্ত করার আবেদন।
Total Reply(0)
Hasan Tarek ৭ মার্চ, ২০২২, ৪:০৫ এএম says : 0
সরকার আর কি ব্যাবস্হা করবে, আগে যখন পিঁয়াজের দাম বেড়েছিল তখন পিঁয়াজ ছাড়া রান্না করার পরামর্শ দিয়েছিলো এখন তেল ছাড়া রান্না করতে বলবে।
Total Reply(0)
Abdus Salam ৭ মার্চ, ২০২২, ৪:০৬ এএম says : 0
সংকট সৃষ্টি করেছে শাসক দলের লোকদের অসৎ সিন্ডিকেট, তাই সয়াবিন তেল বয়কট করুন, এটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, সরিষার তেল খাওয়া শুরু করুন, এটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন