শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সম্পাদকীয়

প্রবীণদের জন্য আনন্দ আশ্রম গড়ে তোলা জরুরি

এম. এ. কাদের | প্রকাশের সময় : ৯ মার্চ, ২০২২, ১২:০৭ এএম

গত ২ ফেব্রয়ারী রাতে লাইভে এসে বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতা এবং পরিবার নিয়ে হতাশার কথা জানান আবু মহসিন খান। তিনি সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। মহসিন খানের কষ্টের কথা, অবহেলার কথা আমরা বুঝতে পারি। এটা মহসিনের একার গল্প নয়, তার মতো হাজারো প্রবীণের অবহেলা আর কষ্টের গল্প। এ গল্প দেশের দেড় কোটি প্রবীনের গল্প। যারা মহসিনের মতো আত্মহত্যা করতে না করে নীরবে চোখে পানি ফেলেন। বর্তমান সমাজে সবচেয়ে অবহেলার শিকার এখন অসহায় প্রবীণরাই। তবে ক্রমবর্ধমান বার্ধক্যের অসহায়ত্ব মোকাবিলা করার মত প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি আমাদের নাই। অসহায় অবস্থার শিকার এই প্রবীণদের সেবা দেয়ার জন্য যে নতুন ব্যবস্থা প্রয়োজন, তা গড়ে উঠছে না। প্রবীণদের কল্যাণের বিষয়ে এখনই আমাদের উদ্যোগী হওয়া জরুরী। বার্ধক্য প্রত্যেক মানুষের অবধারিত পরিনতি। আজকের নবীনই আগামী দিনের প্রবীণ। তাই শ্রদ্ধা ও যতেœর সঙ্গে প্রবীণদের দেখভাল করতে হবে। আর এখন থেকেই নিজেদের স্বস্তিময় বার্ধক্যের প্রস্তুতি নিতে হবে। দয়া-দাক্ষিণ্য বা করুণার দৃষ্টিতে নয়, মানবাধিকারের ভিত্তিতে এবং প্রাপ্য মর্যাদার যুক্তিতে প্রবীণদের চাওয়া পাওয়া সমাধান করা প্রয়োজন। এর জন্য দরকার গণসচেতনতা। এই গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রবীণদের অবহেলা, অযতœ, দুর্ব্যবহার, নির্যাতনের ঘটনা এবং সবার করণীয় বিষয়গুলো পাঠ্য সূচিতে এবং গণমাধ্যম কার্যক্রমে অন্তর্ভূক্ত করতে পারলে প্রবীণদের প্রতি কিছুটা হলেও সম্মান প্রদর্শন করা হবে।

মানুষের গড় আয়ু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৯০ সালে বিশ্বে প্রবীণদের সংখ্যা ছিল ৫০ কোটি। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১০ কোটিতে। ২০৩০ সালে এর সংখ্যা হবে ১৫০ কোটি, এবং ২০৫০ সালে প্রবীণদের সংখ্যা ২০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশে বর্তমান প্রবীণদের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। ২০২৫ সালে প্রবীণদের সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২ কোটি। ২০৫০ সালে দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে চার কোটি। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৬০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে অপ্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় প্রবীণদের সংখ্যা বেশি হবে। এক বেসরকারী জরিপে জানা গেছে, বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লাখ প্রবীণ অসুস্থ, অসহায়, অবহেলিত, নিঃসঙ্গ ও সেবাহীন জীবনযাপন করছেন। সামাজিক মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় অনুশাসনের অভাবে আমাদের দেশে বৃদ্ধ পিতা-মাতা কত যে অসহায় অবস্থায় জীবন যাপন করছেন, বাইরে থেকে সেটা বোঝা যায় না। অনেক সময় বৃদ্ধ পিতা-মাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাড়ী পাহারা, সন্তান দেখাশুনা, বাজার করানো, সন্তানকে স্কুলে পাঠানো, ধমক দিয়ে কথা বলা, অপমানজনক আচরণ করা, চিকিৎসা না করানো, বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে আলাদা রাখা, এমনকি শেষ সম্বল পেনশনের টাকা, জমি-জায়গা বাড়ীটুকু পর্যন্তও জোর করে লিখে নেওয়া হচ্ছে। অনেক বাবা-মা, সন্তান ও পুত্রবধূর কাছ থেকে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এমনকি মাদকাসক্ত ছেলে, মেয়ে, বাবা-মাকে হত্যা পর্যন্ত করছে। অনেক সন্তান বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে বাড়ীতে তালা বন্ধ করে রেখে স্বামী-স্ত্রী তাদের কর্মস্থলে চলে যায়। তাছাড়া পারিবারিক বা সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বা দাওয়াতে পরিবারের সকল সদস্য অংশগ্রহণ করলেও বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে ঝামেলা মনে করে সঙ্গে নিতে চায়না। অনেক প্রবীণদের থাকার জায়গাও নিম্নমানের হয়ে থাকে। যেমন, বাড়ীর নিচতলায়, বারান্দায়, চিলেকোঠায়, খুপরঘরে, গোয়ালঘরে এমনকি বাড়ীর কাজের লোকের সাথে থাকতে দেওয়া হয়। অনেক সন্তানের সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও বিভিন্ন অজুহাতে অসুস্থ পিতা-মাতার এতটুকু খোঁজ-খবর পর্যন্ত নিতে চায় না। আবার অনেকের ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও দারিদ্র্যতার কারণে বাবা-মায়ের যতœ নিতে পারেন না। অসুস্থ বৃদ্ধ পিতা-মাতা তাদের এই কষ্টের কথা কাউকে বলতেও পারেন না। এত কষ্টের পরেও কেউ ভাল মন্দ জানতে চাইলে সন্তানের মুখ উজ্জ্বলের জন্য বলেন, ‘আমি খুব ভাল আছি’। যে প্রবীণ যৌবনে তার মেধা, মনন, দক্ষতা দিয়ে সমাজের অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন, জীবনের সকল সুখ বিসর্জন দিয়ে সন্তানদের মানুষ করেছেন, মানব কল্যাণে অবদান রেখেছেন, বৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে সেই মানুষটি অযতœ, অবহেলার শিকার হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে সমাজের বা সরকারের দায়ীত্ব তাদের উপর বর্তায় না। শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত ও সুন্দর জীবন গড়ার জন্য পিতা-মাতা ও সরকারের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি প্রবীণদের জন্য সন্তান, সমাজ ও সরকারের দায়িত্ব নেয়া উচিত।

প্রবীণদের দুর্দশা এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। এর সমাধান না করলে প্রত্যেককেই বৃদ্ধ বয়সে এই অবহেলা ও কষ্টের শিকার হতে হবে। অনেক সন্তান তাদের কর্মব্যস্ততার কারণে কর্মস্থল ত্যাগ করে বাবা-মায়ের পরিচর্যা বা সেবা যতœ করতে পারে না। অনেক পিতা-মাতা নিজের ভিটা মাটি ছেড়ে বিদেশে সন্তানের সাথে থাকতে পছন্দ করে না। এসব নানা কারণে দিনদিন সন্তানদের সাথে বাবা-মা’র সুসম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। অনেক পিতা-মাতার পুত্র সন্তান না থাকায় জামাই-মেয়ের বাড়ীতে থাকতে পছন্দ করেন না। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটাই উপায় বৃদ্ধাশ্রম নয়, আনন্দ আশ্রম গড়ে তোলা। প্রত্যেক উপজেলায় আনন্দের সাথে বসবাস করার জন্য ‘আনন্দ আশ্রম’ গড়ে তুলতে হবে। যেখানে একই বয়সের অনেকেই থাকার কারণে প্রবীণরা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে স্বেচ্ছায় থাকতে চাইবেন।
প্রত্যেক উপজেলার শহরের কাছাকছি কমপক্ষে পাঁচ একর জমির উপরে আনন্দ আশ্রম গড়ে তুলতে হবে। এতে থাকবে প্রবীণদের সুচিকিৎসার জন্য হাসপাতাল, ভাল নার্সিং ব্যবস্থা, ভাল মানের খাবার, বিনোদনের ব্যবস্থা, প্রার্থনার জন্য মসজিদ, মন্দির, খেলার মাঠ, ব্যায়ামাগার ইত্যাদি। থাকবে ভাল আবাসনের ব্যবস্থা। এখানে যেকোনো প্রবীণ স্বেচ্ছায় থাকতে পারবেন। যাদের দেখার কেউ নেই, স্বামী-স্ত্রী এক সাথে বা একা একা থাকতে পারবেন। ধনী প্রবীণরা ভাড়া বা খরচ দিয়ে থাকতে পারবেন। একই বয়সে অনেকে এক সাথে থাকার কারণে প্রবীণরা আনন্দে থাকতে পারবেন। এতে সন্তান, আপন জনেরা দেশে-বিদেশে যেখানেই থাকুক না কেন বাবা-মা ভালো আছেন ভেবে তারাও নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন। প্রয়োজনে সন্তান, আপনজন বিদেশ থেকে এসে কিছুদিন আনন্দ আশ্রমে বাবা-মাকে সঙ্গ দিতে পারবেন। গরীব অসহায় প্রবীণরা সরকারী খরচে থাকবেন। প্রয়োজন হলে তারা স্বেচ্ছায় কিছুদিন নিজের বাড়ীতে, কিছুদিন আনন্দ আশ্রমে থাকতে পারবেন।

অসহায় প্রবীণদের বিষয়টি জাতীয় সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করে, জনসচেতনতা ও প্রচারের মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আনন্দ আশ্রম গড়ে তোলার জন্য সকলে এগিয়ে এলে তা দ্রæত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। ইতিমধ্যে এই মহৎ উদ্যোগকে বেশিরভাগ সচেতন মানুষ ও ভুক্তভোগী প্রবীণরা স্বাগত জানিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়কে বাস্তবায়নের জন্য সমাজের দানশীল ও বিত্তবানরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চায়। প্রবীণদের জন্য সামাজিক আন্দোলনে তরুণদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন, কারণ প্রবীণদের এই সমস্যা সমাধান না হলে আগামীতে ভূক্তভোগী হবে বর্তমান তরুণ প্রজন্মই।

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন