মরে যেতে বসেছে বৃহত্তর ময়মনসিংহের প্রায় অর্ধ শতাধিক নদ-নদী। সময়ের চোরা স্রোতে পাল তোলে ইতোমধ্যে প্রায় ডজনখানেক নদ-নদী মৃত হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে। মরে যেতে বসা এসব নদীতে এখন শুধুই ধূ-ধূ বালুচর। ফলে কৃষি সংস্কৃতিতেও নেমে এসেছে বেহাল দশা।
এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র নদের নাব্যতা ফেরাতে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চলছে খনন কাজ। ২০১৯ সালের শেষ দিকে শুরু হওয়া কাজে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নদের ২২৭ কিলোমিটার খনন করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিওটিএ)। যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থল জামালপুরের কুলকান্দি থেকে কিশোরগঞ্জের টোক পর্যন্ত নদটি আগামী ২০২৪ সালের জুনে খনন কাজ শেষ হওয়ার কথা।
কিন্তু একদিকে খনন হলেও অন্যদিকে নদের মাঝে জেগে উঠছে চর। খননের পরও কোন নদে চর জাগছে তা এখন ময়মনসিংহবাসীর কাছে প্রশ্নের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, নদের চর জাগার কারণ শনাক্ত না করেই অপরিকল্পিত ভাবে নদ খনন হচ্ছে। এতে সরকারী অর্থের অপচয়ই নয়, সুফল বঞ্চিত হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র। এমন অভিযোগে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি) ব্রক্ষপুত্র নদ খননে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাদ্ধ লুটপাটের অভিযোগে মানববন্ধন করেছে জেলা আওয়ামীলীগ-জাসদ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এ সময় তারা নদ খননের সকল ধরনের তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ করার দাবি জানান।
ওই মানববন্ধনে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরাদ্ধের টাকা দিয়ে কাজ না করে বিল উঠিয়ে নিয়ে যাবেন, তা হতে পারে না। অবিলম্বে নদ খননের সকল ধরনের তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ করা হোক।
এ সময় জেলা আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারন সম্পাদক শওকত জাহান মুকুল বলেন, নদ খননের ২৭ শত কোটি টাকার প্রকল্প আমলা-ঠিকাদার যোগসাজস করে লুটপাট করছে। এই অনিয়ম অবিলমে¦ বন্ধ না হলে আমরা বৃহত্তর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হব।
কবি এম. বাহাদুর বলেন, নদ খননের অনিয়ম নিয়ে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সকল উচ্চ পর্যায়ে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু কোন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে অনিয়মের খননে নদ এখন খালে পরিনত হচ্ছে।
নদের তীরবর্তী বাসিন্দারা জানায়, নদ শুকিয়ে যাওয়ার কারণে নদ কেন্দ্রিক জীবিকা হারিয়ে পথে বসেছেন প্রায় লাখো পরিবার। জীববৈচিত্রেও পড়েছে বিরূপ প্রভাব। মৎস্য সম্পদও ধ্বংসের প্রান্তসীমায়। অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে এক সময়ের যোগাযোগের চালিকাশক্তি নৌপথ। বিলুপ্ত হয়ে গেছে জেলে পল্লীগুলোও।
জানা যায়, নদ-নদীর ব্রক্ষপুত্র নদীর সাথে এ অঞ্চলের মানুষের গভীর মিতালী। বাঙালি জাতির ইতিহাস যেমনি গড়ে উঠেছে নদীকে কেন্দ্র করে তেমনি এ অঞ্চলের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে ব্রক্ষপুত্র। ব্রক্ষপুত্র মরা গাঙে রূপ নেয়ায় এ অঞ্চলের কৃষি সংস্কৃতিতে নেমে এসেছে বেহাল দশা। দিন দিন বিশাল বিস্তৃত মরুপ্রান্তর হয়ে উঠছে এক একটি নদ-নদী। অথচ এক সময় এসব নদ-নদীই ছিল মাছের অভয়ারণ্য। পণ্য পরিবহন ও মানুষের যোগাযোগের সুবিধার কারণে নদপারে গড়ে উঠেছিল ছোট-বড় হাট-বাজার, বন্দর, নগর ও গঞ্জ। এসব এখন শুধুই স্মৃতিময় দীর্ঘশ্বাস।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা গেছে, যৌবনের জলতরঙ্গে এক সময় উচ্ছ্বল ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের এসব নদ-নদী। সেই কারণে নদীর সাথে এ অঞ্চলের মানুষের গভীর মিতালী-এ আপ্তবাক্যও ছিল চিরন্তন সত্য। কিন্তু সময়ের গতিধারায় নদীমাতৃক পরিচয়টাও যেন এখন বিলীন হবার পথে। এসব নদী প্রায় মরেই যাওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রাও বদলে যাচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন করে পরিবেশ বিপর্যয়। এ অঞ্চলের প্রধান নদী স্রোতস্বিনী ব্রক্ষপুত্রও খননের অভাবে এখন মৃতপ্রায়।
স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র মতে, বৃহত্তর ময়মনসিংহে ব্রক্ষপুত্রসহ প্রায় অর্ধ শতাধিক নদ-নদী রয়েছে। এর মধ্যে উলেখযোগ্য হচ্ছে- ঝিনাই, আইমন, সুতিয়া, পুরাতন ব্রক্ষপুত্র, ঘরোটা নদী, সিমাহালি, নরসুন্দর, বোথাই, নিতারী, সোমেশ্বরী, কংশ, গুনাই, কাঁচামাটিয়া, পানকুরা, সাইদুল, মুগরা, রাংরা, খারমরি, মাহাডেবা, জাদুকাটা, ধানু, বাউলাই, শিরখালি, চেলাখালি, মতিচিক, চালহি, বংশাই, মানস, পুটিয়া, জিনজিরাম, সুবনফিরি, বলেশ্বর, বগাই কংশ, কাউলাই, ধনু, সিলাই, রাজবাড়ী ও খারমেনি। এর মধ্যে নরসুন্দা ও রাজবাড়ী’কে মৃত নদী হিসেবে চিহ্নিত করেছে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। বাংলা পিডিয়া বইতেও এসব নদীর কথা বলা হয়েছে। মৃত নদ-নদীর এ তালিকা ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে।
সূত্র মতে, ব্রক্ষপুত্র নদের উৎপত্তিস্থল হিমালয় পর্বতমালায়। বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারি সংলগ্ন এলাকা দিয়ে এর প্রবেশ। এক সময়ের স্রোতস্বিনী ব্রক্ষপুত্র নদ থেকেই বর্তমানের যমুনা নদীর উৎপত্তি হলেও বর্তমানে নদটি স্রোতবিহীন আর নাব্যতা সংকটে ভুগছে। উৎসমুখে জামালপুর জেলার দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা থেকে শুরু করে নদের পতিতমুখে কিশোরগঞ্জের ভৈরব পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় আড়াইশ কিলোমটিার দৈর্ঘ্যের নদটি বর্তমানে তেজহীন শীর্ণকায়া।
বৃহত্তর ময়মনসিংহের জামালপুরের কাছে নদীর তলদেশ উঁচু হয়ে যাওয়ায় ময়মনসিংহে পানি প্রবাহের মাত্রা কমছে। পানির সঙ্কটে বিপন্ন ব্রক্ষপুত্র নদ বর্ষাকাল ছাড়া বাকী মৌসুমে থাকে পানি শূণ্য মরুময়। বছরের পর বছর গড়ালেও ব্রক্ষপুত্র নদ বা অন্যান্য নদীর ভাগ্যাকাশে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ গাঢ় হচ্ছে।
জানা গেছে, আদি অবস্থায় পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের গড়ে প্রশস্থতা ছিল প্রায় ১১ কিলোমিটার। বর্তমানে এর প্রশস্থতা এখন ১২০ মিটার থেকে ২২০ মিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। খনন না করায় নদের বুকে পলি ও বালু জমে অসংখ্য চর জেগে উঠেছে। এর মধ্যে গত ৩৩ বছরে নতুন চর জেগেছে ৭২০ বর্গকিলোমিটার। একই সঙ্গে খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র নদের নাব্য হ্রাস পাওয়ায় তলদেশ ভরাট হয়ে উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৬ মিটার অর্থাৎ ২২ ফুট। ফলে নদে শুষ্ক মৌসুমে নদের দুই পাড়ের ফসলি জমিতে প্রতি বছর ভয়াবহ সেচ সংকট দেখা দেয়।
সূত্র মতে, কয়েক বছর আগেও বৃহত্তর ময়মনসিংহে নদ-নদী তীরবর্তী হাজার হাজার একর জমির আবাদ হতো এসব নদ-নদীর পানি দিয়ে। জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, গাইবান্ধায়ও হাজার হাজার একর জমির আবাদ ছিল ব্রহ্মপুত্রের পানিনির্ভর। উর্বর পলি মাটিতে বাম্পার ফলন হতো। সে অবস্থা আজ আর নেই। যন্ত্রের দাপটে হারিয়েছে উর্বরতা। শীতকালে বৃহত্তর ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র এখন হেঁটেই পার হওয়া যায়। যমুনার উৎস মুখ ভরাট হয়ে গেছে। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বৃহত্তর ময়মনসিংহের এসব নদ-নদীগুলোতে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন