তাকওয়া ও পরহেজগারী একটি শক্তি, যা প্রকৃতই অতুলনীয়। আরবী ভাষায় ‘তাকওয়া’ শব্দের আবিধানিক অর্থ হচ্ছে বেঁধে রাখা, পরিহার করা এবং দূরে থাকা। কিন্তু পবিত্র কোরআনের ব্যবহারিক ভাষায় তাকওয়া বলতে অন্তরের সেই অবস্থা ও পরিবেশকে বুঝায়, যা আল্লাহ তায়ালাকে সর্বদা হাজের ও নাজের হওয়ার বিশ্বাস সৃষ্টি করে এবং অন্তরে ভালো ও মন্দের তারতম্য নির্ণয়ের সাথে সাথে ভালোর প্রতি আকর্ষণ বর্ধিত করে এবং মন্দের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং ঘৃণাকে প্রকট করে তোলে।
অন্য কথায় আমরা বলতে পারি যে, তাকওয়া হচ্ছে অন্তরের অনুভূতি ও অন্বেষার নাম যার প্রতিফলনের মাধ্যমে আল্লাহর নির্দেশ মুতাবিক কাজ করার তীব্র বাসনা পয়দা হয় এবং একই সাথে বিরুদ্ধবাদিতার প্রতি অবজ্ঞা ভাবের উদয় হয়।
মোট কথা, তাকওয়া মূলত অন্তরের ওই অবস্থার নাম, যা কোরআনুল কারীমের এই আয়াত দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় এবং তা আরকানে হজ্জের বিবরণের সাথে সম্পৃক্ত। ইরশাদ হয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর নিদর্শনগুলোর সম্মান করে, তা’ অন্তরের পরহেজগারীর মাধ্যমেই সাধিত হয়। এই আয়াতের আলোকে সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, তাকওয়ার আসল যোগসূত্র অন্তরের সাথে গ্রথিত। এই তাকওয়া অন্তরের নেতিবাচক অবস্থার পরিবর্তে ইতিবাচক বা প্রত্যয়ী মনোবৃত্তির উদয় করে। একই সাথে মঙ্গলকর কর্মানুষ্ঠানের প্রতি অন্তরের অনুপ্রেরণাকে সঞ্জীবিত করে তোলে। একই সাথে আল্লাহর নিদর্শনাবলির সম্মান ও শ্রদ্ধার দ্বারা অন্তরকে পরিপ্লুত করে।
অপর এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে : নিশ্চয়ই যারা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে নিম্নস্বরে কথা বলে তারাই সেই লোক যাদের অন্তরকে আল্লাহ তায়ালা তাকওয়ার জন্য পরীক্ষা করেছেন, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা এবং বৃহত্তর পুরস্কার। এই আয়াতে তাকওয়ার কেন্দ্র বলে অন্তরকেই নির্ধারিত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অনুভূতি তাকওয়ার মাধ্যমেই পয়দা হয়।
আল কোরআনের অপর একটি আয়াতে তাকওয়াকে স্বভাবমূলত ‘ইলহাম’ (অন্তরের প্রেরণা) বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে : সুতরাং প্রত্যেক নফসের মধ্যে এর দুস্কর্ম ও তাকওয়াকে ‘ইলহাম’ করা হয়েছে। এই আয়াতে দুস্কর্ম বলতে স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, তাহলো নাফরমানী ও অপরাধের মূল। ঠিক তেমনিই তাকওয়া হলো যাবতীয় নেক কাজের বুনিয়াদ এবং মূলভিত্তি। এই উভয় প্রকার স্বভাব প্রত্যেক নফস বা বান্দাহকে সৃষ্টির শুভলগ্ন হতেই প্রদান করা হয়েছে। এখন বান্দাহ নিজের আমল ও চেষ্টার মাধ্যমে এর একটিকে পরিত্যাগ করে এবং অপরটিকে গ্রহণ করে।
মোটকথা এই উভয় অবস্থাই ইলহামে রাব্বানীর অন্তর্ভুক্ত। আর একথা সবারই জানা আছে যে, ইলহামে রাব্বানীর কেন্দ্র হচ্ছে অন্তর। তাই, তাকওয়ার মূল কেন্দ্র বা মাকাম হলো অন্তর। তাকওয়া শব্দটি অন্তরের এই অবস্থাকে যেমন বুঝায়, তেমনি এই অবস্থার প্রভাব প্রতিক্রিয়া ও প্রতিফলনের ওপরও ব্যবহৃত হয়। যেমন সাহাবায়ে কেরাম মক্কার কাফিরদের শক্তিমত্তার জবাব প্রদানে এবং তাদের বিরুদ্ধে বদলা গ্রহণের পরিপূর্ণ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হোদায়বিয়ার সন্ধি চুক্তিকে কবুল করে নিয়েছিলেন।
তাছাড়া অপর এক আয়াতে শত্রুর সাথে অঙ্গীকার পালন করা এবং যথা সম্ভব যুদ্ধ পরিহার করাকে তাকওয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। মহান আল্লাহপাক এই শ্রেণির মুত্তাকীদের সাথে নিজের ভালোবাসার স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : (ক) তোমরা তাদের সাথে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অঙ্গীকার পূর্ণ কর। আল্লাহপাক মোত্তাকীদেরকে অবশ্যই ভালোবাসেন। (খ) সুতরাং তারা যতক্ষণ তোমাদের সাথে সঠিকভাবে আচার-ব্যবহার করবে, তোমরাও ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের সাথে সদ্ব্যবহার বজায় রাখবে। অবশ্যই আল্লাহপাক মোত্তাকীদেরকে ভালোবাসেন।
পরিশেষে স্মরণ রাখা দরকার যে, যেমনিভাবে মানুষের অপকর্ম, কুশিক্ষা অসৎসঙ্গ এবং অমঙ্গলকর কর্মকাণ্ড পারস্পরিক ক্ষতিকর প্রভাবকে বিস্তৃত ও সম্প্রসারিত করে, তেমনিভাবে মঙ্গল ও সৎ কর্মকাণ্ডের দ্বারা উত্তম পরিণাম ফলের আশা এবং আকাক্সক্ষার বিস্তৃতি সাধন করে এবং মঙ্গলকামীর আন্তরিক অবস্থা প্রতিনিয়ত সদানুষ্ঠানসমূহের প্রতি অনুরাগ ও অনুরুক্তি প্রকাশ করে।
এই শ্রেণির মোত্তাকীদের প্রশংসা করে মহান আল্লাহপাক আল কোরআনে ইরশাদ করেছেন : যারা হেদায়েতপ্রাপ্ত হয়েছে, আল্লাহপাক তাদের আত্মিক পবিত্রতাকে পরিবর্ধিত করেন। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, তাকওয়া হচ্ছে, এক প্রকার ইতিবাচক এবং সম্পুরক অবস্থা যা মানুষকে আল্লাহপাক দান করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন