শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

ওরা বিচার চায় না কেন?

রাজধানীতে প্রীতি-নাসরিন-নাহিদ-মুরসালিন হত্যাকান্ড

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২২ এপ্রিল, ২০২২, ১২:১৬ এএম

দেশের ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত কারোই আইন ও বিচার ব্যবস্থার ওপরে আস্থা নেই : আলী রিয়াজ


মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুকে হত্যা করা হয় শাহজাহানপুরে। ওই সময় টিপুর গাড়ির পাশেই যানজটের কারণে আটকা পড়েছিল বদরুন্নেসা কলেজের শিক্ষার্থী সামিয়া আফরিন প্রীতি। তার শরীরে সন্ত্রাসীদের গুলি লাগায় তিনিও খুন হন। তার হোসনে আরা বলেছিলেন, ‘বিচার চাই না শুধু লাশ চাই।’ খিলগাঁও তিলপাপাড়া এলাকায় স্বামীর সাথে মোটরসাইকেলে করে বাসায় ফেরার পথে গৃহবধূ নাসরিন খানম দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাকার নিচে পড়ে প্রাণ হারান। তার স্বামী মো. শামীম বলেছিলেন, ‘বিচার পাব না তাই বিচার চাই না।’

নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী-হকারদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষের মাঝখানে পড়ে রক্তাক্ত হন কুরিয়ার সার্ভিস কর্মী নাহিদ হোসেন। পরে মারা যান। নাহিদের বাবা বলেন, ‘আমরা নিরীহ মানু। কারো সঙ্গে ঝামেলার মধ্যে নেই। বিচার চাই না। কাকে আসামী করব আর কার কাছে বিচার চাইব।’ একই ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান দোকানের কর্মচারী মো. মুরসালিন। নিহত মুরসালিনের বড় ভাই নূর মোহাম্মদ বলেছেন, ‘মামলা করে কি হবে? কার নামে মামলা করব। এই দেশে কোনো বিচার নেই। কে করবে বিচার?’ প্রশ্ন হচ্ছে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হওয়া, ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে মানুষ প্রাণ হারালে ভুক্তোভোগী ওই পরিবারগুলো হত্যাকান্ডের বিচার চান না কেন? ভিকটিমের রাষ্ট্রের কাছে বিচার না চাওয়ার নেপথ্যে কি রহস্য লুকিয়ে আছে? এর আগে ২০১৫ সালে জঙ্গীদের হাতে নিহত ফয়সাল আরেফীন দীপনের পিতা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছিলেন, ‘আমি বিচার চাই না।’ ওই সালে নিহত হয়েছিলেন লেখক অভিজিৎ রায়, এক সময় তার স্ত্রী রাফিদা খাতুনও বলেছিলেন ‘আমিও বিচার চাই না। কেননা চাইলেও বিচার পাওয়া যাবে এমন নয়। অনেক হত্যাকান্ডের বিচার চেয়ে পাওয়া যায়নি।’

বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা এবং ভিকটিমের বিচার পাওয়া প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট আলী রিয়াজ তার ফেসবুক পেইজে লিখেছেন, ‘এই যে বিচার না চাওয়া সেটা হচ্ছে দেশে যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তার প্রমাণ। ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অশিক্ষিত কারোই এখন আর আইন ও বিচার ব্যবস্থার ওপরে আস্থা নেই। প্রতিষ্ঠানের ওপরে আস্থা নেই, কেননা প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়েছে।’

ঘটনা-এক : গত ২৪ মার্চ রাতে রাজধানীর শাহজাহানপুরের আমতলা মসজিদ এলাকায় দুর্বৃত্তের এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হন মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু। ওই সময় টিপুর গাড়ির পাশেই যানজটের কারণে সড়কে আটকা পড়েছিল বদরুন্নেসা কলেজের শিক্ষার্থী ১৯ বছর বয়সী সামিয়া আফরিন প্রীতি। এ সময় সন্ত্রাসীদের গুলি এসে লাগে রিকশায় বসে থাকা প্রীতির শরীরে। টিপুর গাড়িচালক মনির হোসেন মুন্নাও গুলিতে আহত হন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাদের হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক দুজনকে মৃত ঘোষণা করেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, মেয়েকে হারিয়ে প্রীতিদের শান্তিবাগের বাসায় শোকের মাতম চলছিল। শোকার্ত মা হোসনে আরা শুধু বলছিলেন, ‘বিচার চাই না। শুধু মেয়ের লাশ পৌঁছে দিলেই হবে।’ আর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের মর্গে প্রীতির বাবা জামাল উদ্দিন বলেছিলেন, ‘একজনকে মারতে গিয়ে আমার মেয়ের শরীরে গুলি লেগেছে। সন্তানের এমন মৃত্যু কোনো বাবা-মা চান না। আমি তো মেয়ে হারিয়েছি। আমি কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিতে চাই না, মেয়ে হত্যার বিচার চাই না। মামলা চালানোর মতো অবস্থাও নেই। আমরা নিরীহ মানুষ। বিচার চেয়ে বিবাদে জড়াতে চাই না। বিচার চাইলে আল্লাহর কাছে চাই।’

ঘটনা-দুই : গত পহেলা এপ্রিল রাতে খিলগাঁও তিলপাপাড়া এলাকায় স্বামীর সাথে মোটরসাইকেলে করে বাসায় ফিরছিলেন ২০ বছর বয়সী গৃহবধূ নাসরিন খানম। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি তাদের মোটরসাইকেলটিকে ধাক্কা দিলে নাসরিন পড়ে যান এবং তার মৃত্যু হয়। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, নিহত নাসরিনের পরিবারের পক্ষ থেকে জিডি করা হলেও কোনো মামলা করা হয়নি। ঘটনার পর গাড়িচালক বকুল মিয়াকে খিলগাঁও থানা পুলিশ আটক করলেও নিহতের পরিবার থেকে কোনো মামলা না করায় তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। নাসরিনের স্বামী মো. শামীম বলেন, বিচার পাব না বলে তার পরিবার বিচার চান না। দেশের ভেতর কত কী ঘটছে! কেউ বিচার পেরেছে? কোনো কিছুই হয়নি। আপনারা সংবাদ (প্রচার) করবেন, জনগণকে জানাবেন।’

ঘটনা-তিন : ১৯ এপ্রিল সকালে কামরাঙ্গীরচরের বাসা থেকে বের হয়ে নিউমার্কেট হয়ে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে যাচ্ছিলেন ২০ বছর বয়সী নাহিদ হোসেন। কিন্তু, নিউ মার্কেটের পাশের নুরজাহান মার্কেটের সামনে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও দোকান কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের মাঝখানে পড়ে গুরুতর আহত হন তিনি। এরপর তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে ওইদিন রাতেই তার মৃত্যু হয়।

কামরাঙ্গীরচরের এই নাহিদ এলিফ্যান্ট রোডের মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের একটি কম্পিউটার সরঞ্জামের দোকানে ডেলিভারিম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। নিহত নাহিদের রোজগার দিয়েই চলতো ৬ জনের পরিবারটি। পুত্রকে হারিয়ে নাহিদের বাবা বলেন, ‘আমরা নিরীহ মানুষ। কারো সঙ্গে ঝামেলার মধ্যে নেই। কে মারল, কেন মারল আমার ছেলেকে। ওর তো কোনো অপরাধ নেই। কারো কাছে বিচার চাই না। বিচার চেয়ে কী হবে? কার কাছে বিচার চাইব? মামলাও করতে চাই না। শুনেছি অনেকে মিলে ওকে বেদম পিটিয়েছে। ও তো কোনো পক্ষের লোক না। নিউ মার্কেটের হকারও না, কলেজের ছাত্রও না।’ বিচার চাইলেও বিচার পাবেন না মন্তব্য করে নাহিদের মা নার্গিস বলেন, ‘আমরা বিচার চাই না। নাহিদকে তো ফেরত পাব না। বিচার চেয়ে কী হবে? বিচার চাইলেই তো আর বিচার পাব না। আমার ঘর-সংসার কীভাবে চলবে?’

ঘটনা-চার : রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় সংঘর্ষে আহত দোকান কর্মচারী মো. মুরসালিন গতকাল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। হাসপাতালে লাশ নিতে এসে তার বড় ভাই নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘ভাইটা কীভাবে মারা গেল, কিছুই জানলাম না। এটা কেবল ও আর আল্লাহ জানেন। ওর শরীরে আঘাত আর ক্ষতের বাইরে আমরা আর কিছুই দেখিনি। মামলা করে কি হবে? কার নামে মামলা করব। এই দেশে কোনো বিচার নেই। কে করবে বিচার?’

উপরের চারটি ঘটনার দিকে নজর দিলে দেখা যায় প্রত্যেকটি ঘটনার ক্ষেত্রেই দুটি মিল রয়েছে। প্রথমত নিহত নাসরিন, প্রীতি, নাহিদ, মুরসালিন প্রত্যেকেই নিরীহ ছিলেন। যেসব ঘটনায় তাদের মৃত্যু হয়েছে সেসবের সাথে তাদের দূরতমও কোনো সম্পর্ক ছিল না। তারা নিতান্তই ভুক্তভোগী। নিহতরা ‘নিরপরাধ’ ছিলেন জেনেও তাদের পরিবার তাদের হত্যার কোনো বিচার চাইছেন না! খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, যারা তাদের নিরীহ প্রিয়জনকে হত্যার বিচার চান না, তাদের মনে কি তবে এমন ধারণা জন্মেছে যে, বিচার চেয়ে কোনো লাভ নেই? কিংবা বিচার হলেও সেটা ‘ন্যায়বিচার’ হবে না? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই এমন প্রশ্ন রাখছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বিচার না পাওয়ার চেয়েও বিচার না চাওয়ার সংস্কৃতি অধিক আশঙ্কাজনক!’

নায়ক ওমর সানি ফেইসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন: ‘এই দায়ভার কে নেবে? আমি বলি বাংলাদেশ নেবে, নেহায়েত গরিব বলে বিচার হবে না? আমি বোনটার সাথে একমত পরিবারের সাথে একমত, কেন হবে না? রাষ্ট্রের উচিত এই পরিবারটাকে স্বাবলম্বী করে দেওয়া, এড়িয়ে যাবেন না রাষ্ট্র কারণ আমরা যে প্রজা রাষ্ট্রের।’ নিহত নাহিদের স্ত্রী ডালিয়া সুলতানা বলেছেন, ‘আমরা গরিব বইলা কেউ বিচারের কথা কয় না। কিন্তু আমি ন্যায্য বিচার চাই। গরিব বইলা আমাগো বিচার থাকবো না, তা না।’ এ ছাড়াও আরো অনেকেই হত্যার বিচার না চাওয়া নিয়ে নানান মন্তব্য লিখেছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, বøগ, টুইটারে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (9)
Md Hakim ২২ এপ্রিল, ২০২২, ৫:০৮ এএম says : 0
বাংলাদেশে একমাত্র প্রভাবশালীদের বিচার আছে আমাদের মত সাধারন মানুষ বিচার পাবে না বলেই বিচার চাচ্ছে না, হয় একজন বিচারালয় বর্তমানে দলীয় ফ্রেমে বন্দি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আছে বলে দেশের মানুষ মনে করে না' সরকারের বিরুদ্ধে রায় গেলে বিচারকদের উপর নেমে আসে অশান্তি জোর করে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া কাউকে বাংলাদেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য করা এমন অবস্থায় মানুষ বিচারের আশা করবে কি করে
Total Reply(0)
Happy Hearts ২২ এপ্রিল, ২০২২, ৫:০৮ এএম says : 0
দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নেই তাই...!
Total Reply(0)
Nor Mohamod Nor ২২ এপ্রিল, ২০২২, ৫:০৮ এএম says : 0
ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে দেশে বিচার নাই
Total Reply(0)
HM Abul Khair Ashrafi ২২ এপ্রিল, ২০২২, ৫:০৮ এএম says : 0
কার কাছে চাইবে?
Total Reply(0)
Md. Naimon Shathik Khan ২২ এপ্রিল, ২০২২, ৫:০৯ এএম says : 0
চাওয়ার পর অধিকার থাকা সত্বেও যদি কোনকিছু না পাওয়া যায় তবে না চাওয়াই ভালো।
Total Reply(0)
Nasir Uddin ২২ এপ্রিল, ২০২২, ৫:০৯ এএম says : 0
এদেশে বিচার নেই, বিচারের র বাদ দিলে যা হয় তাই হয়,,সরকারি লোকজনের জন্য বিচার এক রকমের আর আম জনতার জন্য আরেক রকমের,,,
Total Reply(0)
Dr. Mohammad Ziaul Hoque ২২ এপ্রিল, ২০২২, ৭:১০ এএম says : 0
অবিচার বান্ধব পরিবেশে মানুষ বিচার চায় না। আল্লাহকে ভয় না করলে ও না মানলে এবং শক্তিধরদের পদলেহনে অবিচারের সস্কৃতি গড়ে উঠে। কোর্টে দোড়াদোড়ি করে বিচারের নামে বঞ্চনা পেতে মানুষ কেন শুধু শুধু অর্থ আর সময় নষ্ট করবে। ন্যায় বিচারহীনতা এই যুগের জাহিলিয়াত।
Total Reply(0)
Yousman Ali ২২ এপ্রিল, ২০২২, ৮:৪৭ এএম says : 0
বিচার আছে খমতা দখলদারদের কাছে জামাত হলেই বিচার
Total Reply(0)
মোহাম্মদ দলিলুর রহমান ২২ এপ্রিল, ২০২২, ৯:০৫ এএম says : 0
এত টানা টানী করে লাভ নেই,এই দেশে কেইছ চালাইতে উকিল লাগে,উকিল এবং আদালত বার বার তারিখ করে দশ বিশ বসর পযন্ত কেইছের সমাধান করেন না প্রতি তারিখে টাকা,যারা মারা গেছে তাদের পক্ষে তাহা সম্ভব নয়,তাই সরকার ও বেবসায়ী বসে এদের প্রতি জনকে দুই কোটি টাকা করে দিয়ে দিলেই ভালো হবে।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন