চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে একের পর ভোজ্যতেলের চালান আসছে। আসা মাত্রাই এসব চালান দ্রুত খালাসও হচ্ছে। তবুও হু হু করে বাড়ছে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম। বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে ভোজ্যতেল নিয়ে রীতিমত তেলেসমাতি কাণ্ড চলছে। সরকারের বেঁধে দেয়া দামে মিলছে না ভোজ্যতেল। বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে ক্রেতার পকেট কাটা হচ্ছে বলে অভিযোগ ভোক্তাদের।
ঈদের মধ্যেই প্রতি লিটারে সয়াবিন ৩৮ টাকা এবং পাম তেলের ৪২ টাকা মূল্যবৃদ্ধির সরকারি ঘোষণার পর বাজারে ভোজ্যতেলের হাহাকার শুরু হয়েছে। হাটবাজার আর পাড়া মহল্লার মুদি দোকানে মিলছে না তেল। দোকানিরা বলছেন, তাদের কাছে সরবরাহ নেই। বড় বড় আমদানিকারকেরা বাজারে সরবরাহ দিতে পারছে না। ঈদের ছুটির কারণেও সরববরাহ কমে গেছে।
এই অজুহাতে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। কোন কোন এলাকায় সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ২০ থেকে ৩০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল। তাতে ক্রেতাদের মধ্যে চরম অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। হাটে বাজারে মানুষকে এ নিয়ে নানা ক্ষোভ-অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে। বাসা-বাড়িতে গৃহিণী থেকে শুরু করে হাটবাজার, চায়ের আড্ডায় সর্বত্র আলোচনায় ভোজ্যতেলের মূল্যবৃদ্ধি।
গতকাল শনিবার খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মহানগরী এবং উপজেলা সদরের হাটবাজারে সরকার নির্ধারিত দামে ভোজ্যতেল বিক্রি হলেও, পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। পাড়া মহল্লা এবং গ্রামের মুদি দোকানে অতিরিক্ত দামে বিক্রি হচ্ছে ভোজ্যতেল। কোথাও কোথাও ক্রেতারা আরো মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কায় বেশি করে ভোজ্যতেল কিনছেন। কেউ আবার দাম দর জেনেই তেল না কিনেই ফিরে যাচ্ছেন।
এদিকে, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে একের পর তেলবোঝাই জাহাজ আসছে। সর্বশেষ শুক্রবার আরো ১২ হাজার মেট্রিক টন পাম তেল নিয়ে বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছে এমটি সুমাত্রা পাম নামে একটি জাহাজ। ইন্দোনেশিয়া থেকে এ তেল আমদানি করেছে টি কে গ্রুপ। এ নিয়ে গত কয়েক দিনে ৫৯ হাজার মেট্রিক টন তেল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে মোট ৫টি জাহাজ ভিড়েছে। এর আগে ৪৭ হাজার ৪৪ টন পাম ও সয়াবিন তেল নিয়ে বন্দরে পৌঁছে আরও ৪টি জাহাজ। ২৯ এপ্রিল থেকে ৪ মে পর্যন্ত এসব তেল বন্দর এসে পৌঁছে। এরমধ্যে ওরিয়েন্ট চ্যালেঞ্জের খালাস শেষ হয়েছে। আর বাকি তিনটি জাহাজের তেল খালাস প্রক্রিয়া চলছে।
জান গেছে, ২১ হাজার টন তেল নিয়ে ওরিয়েন্ট চ্যালেঞ্জ, ৭ হাজার টন নিয়ে এন এস স্টিলা, ৭ হাজার ৭৯৯ টন নিয়ে এমটি প্রাইড ও ১১ হাজার ২৪৫ টন নিয়ে সানজিন জাহাজ বন্দরে আসে। ওরিয়েন্ট চ্যালেঞ্জ ও এন এস স্টেলা নামে দুটি জাহাজে আর্জেন্টিনা থেকে অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আনা হয়েছে। এমটি প্রাইড ও এমটি সানজিন নামে বাকি জাহাজ দুটি ইন্দোনেশিয়া থেকে অপরিশোধিত পাম তেল নিয়ে এসেছে। বিদেশ থেকে জাহাজে আনা এসব সয়াবিন তেল প্রথমে পতেঙ্গা ট্যাংক টার্মিনালে রাখা হয়। এরপর সেখান থেকে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি তাদের কারখানায় নিয়ে গিয়ে পরিশোধন করে বাজারজাত করে থাকে।
বন্দরের কর্মকর্তারা জানান, টিকে গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, সেনা কল্যাণ এডিবল অয়েল, বাংলাদেশ এডিবল অয়েল, বসুন্ধরা, এস আলম গ্রুপ, এসএ গ্রুপসহ বড় বড় আমদানিকারকেরা তেল আমদানি অব্যাহত রেখেছে। চট্টগ্রাম বন্দরেও দ্রুততম সময়ে এসব ভোজ্যতেল খালাসের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক ইনকিলাবকে বলেন, গত কয়েকদিনে চট্টগ্রাম বন্দরে ভোজ্যতেল নিয়ে বেশ কয়েকটি জাহাজ এসেছে। এসব জাহাজ থেকে দ্রুত পণ্য খালাস করা হচ্ছে। বন্দরে এখন কোন সমস্যা নেই।
এদিকে, ব্যাপক হারে আমদানি এবং সরবরাহ চেইন স্বাভাবিক থাকার পরও বাজারে তেলের সঙ্কট ও দামে উর্ধ্বগতি নিয়েও রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তে থাকে। এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া তাদের দেশ থেকে পাম তেল রফতানি বন্ধ করায় বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
যুদ্ধের পর সারাবিশ্বের মতো সয়াবিনের বাজারে অস্থিরতা শুরু হলে দেশের তেলের বাজারে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। সরকার বিভিন্ন পর্যায়ে তেলের ওপর বিভিন্ন শুল্ক প্রত্যাহার করে এবং দাম নির্ধারণ করে দেয়। সর্বশেষ এক লাফে প্রতি লিটার সয়াবিন ৩৮ টাকা এবং পাম তেল ৪২ টাকা বাড়ানো হয়। তাতেও বাজার মিলছে না ভোজ্যতেল। দেশের অন্যতম পাইকারি বাজার চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ ও আছদগঞ্জের ব্যবসায়ীরা বলছেন ভোজ্যতেলের আন্তর্জাতিক বাজার দীর্ঘদিন থেকে ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যে গত কয়েক দিনে ডলারের দাম পাঁচ টাকা বেড়েছে। আর তাতে যারা কম দামে এলসি খুলেছেন, তাদের বাধ্য হয়ে বেশি দাম পরিশোধ করতে হচ্ছে।
তবে এ বিষয়ে ক্যাবের কেন্দ্রীয় নেতা একেএম নাজের হোসাইন বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির যে তথ্য দেওয়া হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তা যাছাই বাছাই না করেই তেলের দাম লিটারে রেকর্ড ৩৮ থেকে ৪২ টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা ভোক্তাদের নয়, ব্যবসায়ীদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানে সরকার তাদের উপর কথা বলতে পারবে না। তাই তারা ভোক্তা তথা সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে দাম বাড়িয়ে নিয়েছে। এখন আবার বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করছে। এর মাধ্যমে তারা মূলত শূন্য শুল্কে ভোজ্যতেল আমদানির সুবিধা হাতিয়ে নেওয়ার চক্রান্ত করছে।
অপরদিকে বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিভিন্ন ব্যবসায়িক গ্রুপ সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় খোলাবাজারের দোকানিরা সয়াবিন তেল নিতে পারছেন না। আবার দোকানিরাও তাদের সংগ্রহে যা আছে, তা ইচ্ছেমতো দামে বিক্রি করছেন। ঈদের আগে দাম বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ীক গ্রুপ হঠাৎ করে বাজারে সরবরাহ কমিয়ে দেয়। এখন সরকার তাদের কথা মতো দাম বাড়ালেও তারা বাজারে সরবরাহ করছে না। আর নেপথ্যে নতুন কোন কারসাজি আছে বলে মনে করেন ভোক্তারা।
যশোর ব্যুরো জানায়, রোজার আগে থেকেই বাড়তে শুরু হয়েছিল সয়াবিন তেলের দাম। যার লিটারে বেড়েছে ৩৮ টাকা। ক্রেতারা বলছেন, বেশি দামের চেয়েও বড় সমস্যা টাকা দিয়েও পণ্য কিনতে পারছেন না তারা। কারণ বাজারের বিভিন্ন পণ্যের জোগান হঠাৎ করেই কমে গেছে।
সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ১৯৮ টাকা ঘোষণা আসার পর থেকেই এ নিয়ে চলছে সমালোচনা। তবে সেই সমালোচনার আগুনে ঘি ঢালছে বাজার থেকে সয়াবিন তেলের উধাও হয়ে যাওয়ার খবর। আর খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঈদুল ফিতরের বন্ধের কারণে এ সপ্তাহে পণ্য এসেছে কম। সরবরাহ স্বাভাবিক হতে সপ্তাহখানেক সময় লাগবে।
এর আগে বৃহস্পতিবার ঈদুল ফিতরের ছুটির পর প্রথম কর্মদিবসে বোতলজাত তেল লিটারে ৩৮ টাকা আর খোলা সয়াবিন তেল লিটারে ৪৪ টাকা বাড়ানোর কথা জানানো হয়। বাণিজ্য সচিবের সঙ্গে মিল মালিকদের বৈঠকের পর এই বিজ্ঞপ্তি দেয় বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স ও বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। বলা হয়, শুক্রবার থেকে নতুন এই দর কার্যকর হবে।
গতকাল শনিবার বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সয়াবিন তেল নিয়েই বাজারে যত আলোচনা, কথা কাটাকাটি আর তর্ক। নতুন নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, ক্রেতারা প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯৮ টাকা, এজন্য দোকানগুলোতে আগে থেকেই মজুত রাখা সয়াবিন তেলও বিক্রি হচ্ছে নতুন দামে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, তেল নতুন না পুরনো সেটি বিষয় না, দাম বেড়েছে তাই দাম বেশি রাখা হচ্ছে। আর খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৮০ টাকা নতুন দাম, কিন্তু খোলা তেল প্রতি লিটার ২২০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আর পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৮৫ টাকা। একইসঙ্গে প্রতি লিটার পাম অয়েল বিক্রি হবে ১৭২ টাকায়।
মোল্লাপাড়ার বাসিন্দা রাজু জানান, বেশি দামের চেয়েও বড় সমস্যা টাকা দিয়েও তেল কিনতে পারছেন না। বাজার থেকে ২১০ টাকা লিটার করে তেল নিয়ে বাড়ী যাচ্ছি। এরপরের বার কি করা হবে কে জানে।
ফেব্রুয়ারির শেষে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার কারণে তেল সরবরাহে অবনতি হওয়ার কারণে এই দাম বেড়েছে। ওই সময় থেকেই বিশ্ববাজারে তেলের দাম কিছুটা বাড়তি থাকলেও সবশেষ তেলের বাজারে বড় ধাক্কা লাগে ইন্দোনেশিয়ার পাম তেল রফতানি স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তে। এ ঘটনার আগে ১৩০ টাকায় ভালো পাম অয়েল মিলত বাজারে।
সিলেট ব্যুরো জানায়, সয়াবিন তেলের সঙ্কট চলছে সিলেটের পাইকারি বাজারেও। সিলেটের পাইকারী বাজারের আদিস্থান নগরীর কালীঘাট ও মহাজনপট্টিতেও সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সঙ্কট দেখানো হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, অতি মুনাফার লোভে অনেক বড় বড় দোকানদাররা অতি গোপনে মজুত করে রেখেছেন সয়াবিন তেল। কিন্তু প্রকাশ্যে দেখাচ্ছেন তেল নেই। কারণ তেলের দর বাড়ার আগাম খর্বও তাদের কানে ছিল, সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাতারাতি লাভবান হ্ওয়ার চেষ্টা করছেন ব্যবসায়ীরা। তবে কোনো কোনো দোকানে সয়াবিন তেলের সঙ্গে অন্য পণ্য কিনতে বলা হচ্ছে। এছাড়া বেশিরভাগ দোকানে বোতলের গায়ে পুরোনো মূল্য থাকলেও বিক্রেতারা হাঁকাচ্ছেন নতুন দাম। মনে হচ্ছে দর বাড়ার পর তারা সয়াবিন তেল বিক্রির জন্য নিয়ে এসেছেন। আসলে তা নয়, কপাল খুলে গেছে তাদের দর বাড়ার খবরে। এখন ঝোপ বুঝে কোপ মারছেন তারা। সে কারণে সিলেটের গাঁও গেরামের দোকানেও তেলে দাম বেড়ে গেছে। অথচ রমজানে এই তেলগুলো বিক্রির জন্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। অপরদিকে, বিক্রেতারা তেল শুধু দরে বিক্রি করছেন না, বলছেন তেল পাওয়া যাবে কি না তা বল দুষ্কর। মানুষের মধ্যে তেল সঙ্কটের একটি আতঙ্ক ছড়িয়ে দিচ্ছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। এমন খবরে সিলেটের গাঁও গেরামে তেল নিয়ে নানা কথা মুখে মুখে।
গতকাল সিলেটে বিভিন্ন স্থানে সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সিলেটের সব কটি পাইকারি ও খুচরা দোকানে তেলের গায়ে পুরোনো মূল্য লেখা থাকলেও সেগুলো বিক্রি হচ্ছে নতুন দামে।
বগুড়া ব্যুরো জানায়, বোতলজাত সয়াবিন তেলের লিটার প্রতি দর ১৯৮ টাকা হলেও ২শ বা তারও বেশিতেও মিলছেনা সয়াবিন তেল। এই চিত্র বগুড়া শহর, শহরতলী এবং উপজেলা এবং গ্রাম এলাকার সর্বত্র। ক্রেতারা বলছেন, ক্রয় ক্ষমতা না থাকায় তারা রান্নার আইটেম কমিয়ে দিয়েছেন। তারপরও যেটুকু প্রয়োজন সেটাও তারা বেশি দাম দিয়েও দোকানে পাচ্ছেন না।
তারা মজুদদার ও মুনাফাখোর মহাজনদের গোডাউনগুলো তল্লাশীর জন্য প্রশাসনের কাছে মিনতি করছেন। বগুড়ার ফেসবুক ইউজাররা তাদের ওয়ালে সয়াবিন তেল নিয়ে তাদের ক্ষোভের কথা লিখছেন। বাজার মনিটরিং করার কথাও বলছেন ভুক্তাভোগী ক্রেতারা। অন্যদিকে, বগুড়ার কেন্দ্রীয় পাইকারি বাজার রাজাবাজারের কয়েকজন মহাজনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, ঈদের ছুটির কারণে খুচরা দোকানগুলোতে নতুন সরবরাহ যায়নি। মুলত সেকারণেই কিছু কিছু দোকানে হয়তো তেল পাওয়া যাচ্ছে না। দুয়েকদিনের মধ্যেই এটা ঠিক হয়ে যাবে বলে জানান মহাজনরা।
পটুয়াখালী জেলা সংবাদদাতা জানান, পটুয়াখালীর বাজারগুলোতে নেই কোনো ব্রান্ডের বোতলজাত সয়াবিন তেল। গতকাল শনিবার দুপুরে পটুয়াখালীর সবচেয়ে বড় বাজার নিউমার্কেটের পাইকারী বড় দোকান থেকে শুরু করে ছোট কোনো দোকানেই বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যায়নি। এ সময় বেশ কিছু দোকানে খোলা পামঅয়েল যা সুপার নামে পরিচিত এবং লুজ সয়াবিন নামে পরিচিত সয়াবিন তেল বিক্রি হতে দেখা গেছে বোতলজাত সয়াবিন তেলের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি মূল্যে।
নিউমার্কেটের মুদী দোকানি নাসির জানান, পাইকারী দোকান থেকে সুপার অয়েল ১৯৫ টাকায় কিনে ২০০ টাকায় এবং লুজ সয়াবিন ২০৬ টাকায় কিনে ২১০ টাকায় বিক্রি করছেন দোকানদারা। বোতলজাত সয়াবিন তেল যা ছিল ঈদের সময় তা সব বিক্রি হয়ে গেছে, একই কথা একাধিক মুদি দোকানদারের। এছাড়াও তারা জানান, ঈদের আগইে কোম্পানী থেকে কম তেল সরবরাহ করা হচ্ছিল, চাহিদা অনুযায়ী তারা তেল পাননি কোম্পানীর এজেন্টদের কাছ থেকে। এদিকে ঈদের পরপরই সয়াবিন তেলের দাম নতুন করে বৃদ্ধি, অন্যদিকে ব্যাংকগুলি বন্ধ থাকায় কোম্পানীতে এজেন্টরা টাকা পাঠাতে না পারার কারণে সাময়িকভাবে বোতলজাত তেলের সঙ্কটের সুযোগে খোলা তেল বেশী দামে বিক্রি হচ্ছে।
পটুয়াখালীতে ফ্রেশ ব্রান্ড সয়াবিন তেলের এজেন্ট মো. রনি জানান, রোজার প্রথম দিকে দেয়া টাকার মালামাল দেয়া হয় কোম্পানী থেকে ৭ থেকে ১০ দিন পরে। ঈদের এক সপ্তাহ আগ থেকে কোম্পানী টাকা নেয়া বন্ধ করে দেয়। যার ফলে ঈদের সময় চাহিদা অনুযায়ী তেল তারা বাজারে সরবরাহ করতে পারেননি। বর্তমানে তাদের কাছে কোনো বোতলজাত তেল নেই, ব্যাংক খুললে নতুন রেটের মালামাল আনার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
এছাড়াও তীর ব্রান্ড তেলের এজেন্ট মৃত সুবল দাসের ভাই শেখর দাস জানান, কোম্পানী থেকে তেলের সাথে অন্য মালামাল যেমন- তীর কোম্পানীর পানি, চাপাতা, মিনিকেট, চিনি গুড়া চাল, মুড়ি, আটা, ময়দা, সুজি, হালিম, ফিরনী মিক্স, চিনি আনার শর্তে সরবরাহ করবেন বলে তাদেরকে কোম্পানীর প্রতিনিধি জানিয়েছেন। এখন তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন টাকা পাঠাবেন কিনা নতুন করে তেল আনতে, কেননা শর্তের ওই সকল মালামাল বিক্রি করা তাদের জন্য অনেক কষ্ট হয়ে যায়। তিনি আরো জানান, ঈদকে সামনে রেখে রোজার শুরুতে ৬ এপ্রিল তিনি কোম্পানীতে চাহিদা দিয়েছিলেন তেলের জন্য তখনই তাদেরকে কোম্পানী থেকে ঐসব মালামালের শর্ত আরোপ করা হলে তিনি আর টাকা পাঠাননি । যার ফলে রোজার শুরুর দিকে তাদের কাছে মজুদকৃত মালামাল দিয়ে বাজারের চাহিদা পূরণ করতে পারলেও ঈদের বাজারে কোনো তেল তারা বিক্রি করতে পারেননি।
বাজারে ক্রেতা খোকন দাস জান, কোন দোকানেই বোতল জাত সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছেনা। খোলা তেল বিক্রি হচ্ছে বোতলজাত তেলের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশী মূল্যে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, লিটার প্রতি ৩৮ টাকা বাড়ালেও দোকানে পাওয়া যাচ্ছেনা বোতলজাত ভোজ্যতেল। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে বিভিন্ন বাজারের মুদি দোকান ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরবরাহ স্বাভাবিক হতে সপ্তাহখানেক সময় লাগবে। এই কয়েক দিনে বোতলের গায়ে লেখা বেশি দামের তেল আসতে শুরু করবে। এক বছরেরও বেশি সময় ধরেই বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী আর বাংলাদেশ তার চাহিদার সিংহভাগ তেলই আমদানি করে থাকে।
ফেব্রুয়ারির শেষে ইউক্রেনে রুশ হামলার পর সরবরাহ পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। এর মধ্যে পাম তেলের বড় সরবরাহকারী ইন্দোনেশিয়া তেল রফতানির সিদ্ধান্ত স্থগিতের কথা জানালে বাজার আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়। ঈদের আগে আমদানিতে ৫ শতাংশ রেখে ভোজ্যতেলে সবধরনের ভ্যাট ও ট্যাক্স প্রত্যাহারের পর তেলের দাম লিটারে কমানো হয়েছিল ৮ টাকা। তবে ঈদ শেষে প্রথম কর্মদিবস বৃহস্পতিবার বোতলজাত তেল লিটারে ৩৮ টাকা আর খোলা সয়াবিন তেল লিটারে ৪৪ টাকা বাড়ানোর কথা জানানো হয়।
বাণিজ্য সচিবের সঙ্গে মিলমালিকদের বৈঠকের পর এই বিজ্ঞপ্তি দেয় বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স ও বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন।
নতুন নির্ধারিত দাম অনুযায়ী, ভোক্তাপর্যায়ে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম ১৯৮ ও খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৮০ টাকায় বিক্রি হবে।
এ ছাড়া পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৯৮৫ টাকা। একই সঙ্গে প্রতি লিটার পাম অয়েল বিক্রি হবে ১৭২ টাকায়।
গতকাল শনিবার সকালে মোগরাপাড়া, দোকানে দোকানে ঘুরে তেল পাওয়া যায়নি। সরিষা তেল থাকলেও দাম চড়া। এক লিটার বিক্রি হচ্ছে ৩৫০-৩৬০ টাকায়। ব্যবসায়ীদের আলাপ করলে তারা জানান, ডিলারদের কাছে তেল চেয়ে পাওয়া যাচ্ছেনা। ঈদের আগে থেকে দোকানে সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধ।
রোজার শেষ দিকে চড়া দামে তেল কিনতে হয়েছে। সান আর মোস্তফা ছাড়া অন্য কোন কোম্পানির তেল ডিলার দোকানে বিক্রি করেনি। রূপচাঁদা, তীর, ফ্রেশ ও বসুন্ধরার মতো বড় কোম্পানির তেল সরবরাহ করা বন্ধ রেখেছে। দু-একটি কোম্পানির তেল বাজারে আসলেও তা কিনেতে হয়েছে মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত দামে। এ জন্য বিক্রি করতে হয়েছে বেশি দামে ৷কিন্তু চাহিদামতো তেল ছিলনা বাজারে। ঈদের আগেই মজুদ তেল বিক্রি শেষ।
বৃহস্পতিবার দাম বাড়ানোর ঘোষণার পরও মিলছেনা বোতলজাত সয়াবিন তেল। কোম্পানির প্রতিনিধিরা আটা, ময়দা ছাড়া অর্ডার নিচ্ছেনা। তেলের ব্যাপারে জানতে চাইলে বলেন, তেল আসলে পাবেন। এই সপ্তাহের শেষের দিকে পেতে পারেন।
নারায়ণগঞ্জের বেশ কয়েকটি এলাকায় সয়াবিন তেলের দেখা নেই বললেই চলে। দু-একটি দোকানে আগের কিছু তেল আছে। সেটা বিক্রি করছেন নতুন দামে। তবে গায়ে লেখা আগের দাম। রোজার আগের তেল যা ছিল ঈদের তিন-চার দিন আগেই বিক্রি শেষ। এখনও মুল্য বৃদ্ধির নতুন তেল বাজারে আসেনি। এই সপ্তাহের শেষের দিকে অথবা আগামী সপ্তাহ থেকে সব কোম্পানির তেল বাজারে আসতে পারে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন