দুই মাস ধরে চাহিদামতো ভোজ্যতেল মিলছে না বাজারে। রমজানে শুরু হওয়া এ সংকট এখন নতুন মাত্রা পেয়েছে। তার উপর ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানকে কেন্দ্র করে সারাবিশ্বেই হুহু করে বাড়ছে ভোজ্যতেলসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম। দেশে ভোজ্যতেলের শতকরা ৯০ ভাগই আমদানি নির্ভর। বাকি মাত্র ১০ শতাংশ উৎপাদন নিজস্ব। এমতাবস্থায় আমদানি বাড়ানো এবং আমদানির বিকল্প সূত্র অনুসন্ধানের পরামর্শ বাজার বিশ্লেষকদের। একই সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে নিজেদের উৎপাদন কিভাবে বাড়ানো যায় সেদিকেও নজর দেয়ার তাগিদ তাদের।
সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের (সিপিডি) ফেলো প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের উৎপাদন করতে গেলে সময় লাগবে। আমরাতো ভোজ্যতেলের ক্ষুদ্র একটা অংশ (১০ শতাংশ) উৎপাদন করি। বাকিটা আমদানি করতে হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সানফ্লাওয়ার ওয়েলের সবচেয়ে বড় উৎস রাশিয়া থেকে তেল আমদানি বন্ধ রয়েছে। উন্নত দেশগুলোর ও নিজেদের চাহিদা পূরণ করতে এরমধ্যে আবার ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। যুদ্ধ দীর্ঘ মেয়াদী হলে এর প্রভাব আরও ব্যপকভাবে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ অবস্থায় আমদানি সূত্রগুলো আরও কোন জায়গা থেকে করা যায় বা যেসব দেশ থেকে আমরা আমদানি করি তাদের সাথে সমঝোতা কিভাবে করা যায় এটা হলো সল্পমেয়াদী একটি পন্থা।
ভোজ্যতেল ইস্যুতে গতকাল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, সত্য যতই কঠিন হোক তা মেনে নিতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশে তেলের মূল্যবৃদ্ধি মেনে নিন। তবে খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ের অনেক ব্যবসায়ী এই পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছেন। তারা ইতোমধ্যে চিহ্নিত। যখন যেখানে প্রয়োজন সেখানে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে এবং হবে। প্রয়োজনে র্যাবের সহযোগিতা নেয়া হবে। এছাড়া বাজার ব্যবস্থাপনায় নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করা ভুল হয়েছে। ব্যবসায়ীরা কথা রাখেননি। যে কারণে বাজার ব্যবস্থাপনায় আমি ব্যর্থ হয়েছি।
আন্তর্জাতিক বাজারের উপর অতি নির্ভরশীলতা কখনোই ভালো কিছ বয়ে আনে না বলে মনে করেন ড. মুস্তাফিজুর রহমান। এছাড়া বাজার ব্যবস্থাপনায় আরও সতর্ক থাকার পরামর্শ তার। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় দেশীয় উৎপাদনকারীদের জন্য নতুন সম্ভাবনা দেখছেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, যেহেতু দাম বেড়েছে আমাদের দেশে কিন্তু উৎপাদনের দিক থেকে দামটাও একটা প্রণোদনা হতে পারে। আগে অনেক সময় বিকল্প যেগুলো উৎপাদন করা হতো এবং সেটা লাভজনক হতো বেশি। সেটা তুলনায় এখন যেহেতু দাম বেড়েছে সেহেতু এটা কিন্তু কৃষকের জন্য আরও লাভজনক বলে প্রমানিত হবে। সে জায়গাটাকেও কাজে লাগানো যেতে পারে বিভিন্ন প্রণোদনার মাধ্যমে।
বাংলাদেশে মূলক সয়াবিন তেল আমদানি করা হয় ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনা থেকে। কিন্তু সেখানেও কমেছে উৎপাদন। ফলে রাতারাতি বেড়েছে সয়াবিনের দাম। অন্যদিকে বাংলাদেশে ভোজ্যতেল হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় সয়াবিন তেল। এর বাইরে পাম ওয়েল, সূর্যমুখী তেল, জলপাই তেল বা সরিষার তেলও ভোজ্যতেল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সূর্যমুখী তেলের অন্যতম উৎস রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় উন্নত দেশগুলোতেও সূর্যমুখী তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে বিকল্প হিসেবে বেড়েছে সয়াবিনের ব্যবহার। এটাও সয়াবিনের দাম বাড়ার অন্যতম একটি কারণ।
তবে এর বাইরেও তেলের অবৈধ মজুদ ও অতিরিক্ত দামে বিক্রি রোধ করতে পারলেও একটি ভালো সমাধানের সুযোগ তৈরি হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। গতকালও রাজধানীর ডেমরা রোডের কাজলা ব্রিজ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে ভোক্তা অধিকার অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। সেখানে তিনটি প্রতিষ্ঠানকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। মজুদদারদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়ে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, আমরা খুব সহজেই এমনটি হতে দেব না। বাজার বাজারের গতিতে চলবে। পাশাপাশি কেউ যাতে পুরোনো দামের তেল নিয়ে কারসাজি করে অতি মুনাফা করতে না পারে তা ধরতে নানা ধরনের মেকানিজম করছি।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার ছুতায় ভোজ্যতেল নিয়ে মনোপুলি ব্যবসা করছেন কিছু ব্যবসায়ী। যে পরিমাণ ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে, তাতে সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার কথা। বাজারে ভোজ্যতেলের কৃত্রিম সংকট কেন তৈরি করা হলো? সরকার ভোক্তার সুবিধার্থে ট্যাক্স-ভ্যাটে ছাড় দিয়েছে। এখন আবার নতুন করে ছাড় চাইছেন ব্যবসায়ীরা। এ জন্য সরবরাহ কমিয়ে সংকটকে দীর্ঘায়িত করছেন তারা। শীর্ষ আমদানিকারকদের পণ্য খালাস কার্যক্রম তদারকি করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে বলে জানান তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন