শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

প্রবাসীদের সুরক্ষা দিতে হবে

মো. আরাফাত রহমান | প্রকাশের সময় : ২৬ মে, ২০২২, ১২:০৬ এএম

বৈদেশিক কর্মসংস্থান বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত। প্রবাসী বাংলাদেশিদের কল্যাণ নিশ্চিত করা, বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মীদের অসামান্য অবদান ও অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করা এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে অভিবাসন খাতের কার্যক্রমকে অধিকতর সুষ্ঠু, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও গতিশীলভাবে পরিচালনার জন্য কৌশলগত দিক-নির্দেশনা প্রদান অপরিহার্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করার লক্ষ্যে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও কর্মী প্রেরণ বিষয়ে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশসমূহের সাথে সমঝোতা সৃষ্টি হয়। তারই ধারাবাহিকতায় সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে বাংলাদেশি কর্মী গমন শুরু হয়।

শ্রম-অভিবাসনের প্রবণতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এবং প্রবাসী বাংলাদেশি ও অভিবাসী কর্মীদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শ্রম-অভিবাসন ব্যবস্থাপনা, পরিচালনা ও কল্যাণ সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ২০০১ সালে ‘প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়’ নামে একটি পৃথক মন্ত্রণালয় গঠিত হয়। অভিবাসী কর্মীদের অধিকারের সুরক্ষা আন্তর্জাতিক মহলে সর্বাধিক গুরুত্বপ্রাপ্ত একটি বিষয়। এমন প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশ ২০১১ সালে জাতিসংঘের ১৯৯০ সালের অভিবাসী কর্মীসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ অনুসমর্থন করে।

আন্তর্জাতিক সনদটির অনুসমর্থনের পর শ্রম অভিবাসন ব্যবস্থাপনা, অভিবাসী কর্মীর অধিকার ও সুরক্ষা এবং অভিবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের কল্যাণের বিষয়টি প্রাধান্য পায় এবং সে পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যমান আইন-বিধিমালা ও নীতিমালা পরিবর্তন ও সংশোধনের আবশ্যকতা ও বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, নিরাপদ ও ন্যায়সংগত শ্রম অভিবাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন, সকল অভিবাসী কর্মী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিত এবং বাংলাদেশ কর্তৃক অনুসমর্থিত ওঈজগড এবং শ্রম ও মানবাধিকার বিষয়ক অন্যান্য সনদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করার উদ্দেশ্যে ওসসরমৎধঃরড়হ ঙৎফরহধহপব, ১৯৮২ রহিত করে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন, ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়।

২০১৫ সালে জাতিসংঘে গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় জাতীয় ও বৈশ্বিক উন্নয়নে অভিবাসনের গুরুত্ব ও ভূমিকার কথা তুলে ধরে এর স্বীকৃতিস্বরূপ অভিবাসন সংক্রান্ত এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতোপূর্বে জাতিসংঘে গৃহীত এমডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করে। ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় শ্রম অভিবাসন খাত সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য, অভিবাসী কর্মীদের সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিতে এবং দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

বৈদেশিক কর্মসংস্থান উৎসাহিত করার লক্ষ্যে গৃহীত প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পদক্ষেপ ও জেন্ডারসংবেদনশীল কার্যক্রমের ফলে সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে নতুন নতুন গন্তব্য ও পেশায় অভিবাসী নারীকর্মীর বহির্মুখী অভিবাসনের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। গন্তব্য দেশও তাদের শ্রম-অভিবাসন বিষয়ক আইনকানুন সহজতর করছে এবং কর্মীদের সুরক্ষায় অধিকতর মনযোগী হচ্ছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশি কর্মীদের বৈদেশিক কর্মসংস্থান-চুক্তির লঙ্ঘন এবং কর্মীদের শোষণ ও নির্যাতনসহ নতুন নতুন চ্যালেঞ্জেরও সৃষ্টি হচ্ছে, যা অভিবাসী কর্মীদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে।

নারীদের কর্মদক্ষতায় বৈচিত্র্য আনয়ন এবং তাদের সার্বিক ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানে নারী কর্মী প্রেরণের নতুন সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে সরকার বিভিন্ন নীতি ও কর্মসূচি জেন্ডারসংবেদনশীলভাবে প্রয়োগ করতে সচেষ্ট। বাংলাদেশে ক্ষুদ্র ও সামষ্টিক উভয় ক্ষেত্রের অর্থনীতির নীতি-নির্ধারণে শ্রম-অভিবাসন একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক উপাদান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বর্তমানে প্রবাসী আয় বা বিদেশ থেকে প্রেরিত রেমিটেন্সের পরিমাণ জিডিপির প্রায় ছয় শতাংশ, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে সমৃদ্ধ এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে স্থিতিশীল করেছে।

সরকারের বর্তমান নীতির প্রধান লক্ষ্য হলো নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসনের মাধ্যমে স্বনির্বাচিত বৈদেশিক কর্মসংস্থান উৎসাহিত ও নিশ্চিতকরণ, যা জাতীয় প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে, অভিবাসী কর্মী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি ও সার্বিক সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং নারীর ক্ষমতায়নসহ বেকারত্ব ও দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়তা করবে। অভিবাসী কর্মীরা জাতীয় অর্থনীতিতে এবং তাদের পরিবারের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে যে অসামান্য অবদান রেখে চলেছে তার স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে তাদের জন্য একটি অধিকার-ভিত্তিক সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা এই নীতির অন্যতম লক্ষ্য। এই লক্ষ্যে সরকার ‘প্রবাসকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতি ২০১৬’ এর মাধ্যমে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টিতে অঙ্গীকার ব্যক্ত করছে, যা প্রত্যেক কর্মীর সম্মান ও মর্যাদাকে স্বীকৃতি দেয়, অভিবাসী কর্মীদের প্রতি সহনশীলতা, সহানুভূতি ও সম্মানবোধ জাগ্রত করে এবং দায়িত্বশীল ও সংশ্লিষ্ট সকলকে শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করতে উৎসাহ যোগায়।

অভিবাসী কর্মীরা, বিশেষ করে স্বল্প দক্ষ কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিগ্রস্ত। অভিবাসী কর্মীরা স্বদেশ ও প্রবাসে শোষণ, নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হন। এই বাস্তবতার নিরিখে তাদের সুরক্ষা প্রদানে আইনি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ অব্যাহত রাখতে হবে। তবে এক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রয়োগই হলো মূল চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ হতে বহির্মুখী শ্রম অভিবাসন বৃদ্ধির অব্যাহত ধারার কারণে শ্রম অভিবাসন ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে।সম্প্রতি বর্হিগামী কর্মীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় অভিবাসী কর্মীদের শোষণ, নিপীড়ন ও তাদের নিয়োগ-চুক্তি লঙ্গনের ঘটনাও বৃদ্ধি পেয়েছে। সে বিবেচনায় বৈদেশিক কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি এবং অভিবাসীদের সুরক্ষা এ দুই লক্ষ্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই হবে ভবিষ্যত শ্রম অভিবাসন সংক্রান্ত নীতিমালা গ্রহণ ও কর্মসূচি পরিকল্পনা করার মূল চ্যালেঞ্জ।

অভিবাসন-ব্যয় ও অভিবাসনের সুফল, অভিবাসী কর্মীদের অধিকার ও দায়দায়িত্ব, তাদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত সুযোগ-সুবিধা এবং বিদেশে কাজের পর্যাপ্ততা ইত্যাদি বিষয়ে পর্যাপ্ত তথ্য না থাকায় অভিবাসী কর্মীগণ অনিয়মিত অভিবাসন, মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, হয়রানি, শোষণ, ও পাচারের মতো অভিবাসন সম্পৃক্ত ঝুঁকিতে পরেন। এছাড়া, অভিবাসী কর্মীর দেশে রেখে যাওয়া পরিবারের সদস্যদেরও, বিশেষ করে, শিশুর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ও যৌন নিপীড়ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানে আগ্রহী কর্মীদের অধিকাংশই স্বল্প শিক্ষিত আর তাদের অনেকেই ঝুঁকি গ্রহণ করে অনানুষ্ঠানিক মাধ্যম ওসরকারি নিবন্ধন প্রক্রিয়ার বাইরে বিদেশে কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে।

বাংলাদেশের আইনি, রাজনৈতিক ও সামাজিক নীতিমালা এবং বাংলাদেশ কর্তৃক অনুসমর্থিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সনদে নারী কর্মীদের প্রতি বৈষম্যরোধ এবং তাদের অধিকার সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এসব নীতির অনুশীলন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা একটি চ্যালেঞ্জ। নারী কর্মীরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হন তার মধ্যে অন্যতম হল তথ্য প্রাপ্তির অভাব। বিনামূল্যে প্রশিক্ষণের সাম্প্রতিক উদ্যোগ সত্ত্বেও নারী কর্মীরা উপযুক্ত ট্রেইনিং ইন্সটিটিউটে ভর্তি, চাকরির সুযোগলাভ, প্রাথমিক তথ্যপ্রাপ্তি ও নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধির করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হন।

শ্রম অভিবাসন-সুরক্ষা ও সহযোগিতা প্রদানে নিয়োজিত বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে তাদের কার্যক্রমে লিঙ্গ-সংবেদনশীল নীতি অনুসরণ করতে হবে। নারীদের অভিবাসনের হার বাড়ানোর লক্ষ্যে বিদেশে বাংলাদেশি মিশনসমূহ দূতাবাসের শ্রম-বিষয়ক কর্মকর্তা ও শ্রম উইং এবং অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার ওপর বিশেষ দায়িত্ব অর্পণ করা প্রয়োজন। বৈশ্বিক প্রেক্ষিত এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নে অভিবাসনের অনন্য অবদানের যথাযথ মূল্যায়ন ও স্বীকৃতির জন্য শ্রম অভিবাসন বিষয়ক নীতিকে সামগ্রিক অর্থনীতি কিংবা খাতভিত্তিক ও অন্যান্য সামাজিক ও শ্রম সংশ্লিষ্ট নীতিকাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করা একান্ত আবশ্যক।

তবে জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্য হ্রাস, সামাজিক ব্যয় হ্রাস, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আহরণ, দেশের আমদানি-ক্ষমতা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক ঘাটতি হ্রাস, দেশের বেকারত্বের হার হ্রাস এবং কৃষি-আবাসন-শিল্প ও যৌথ মালিকানা-ভিত্তিক ব্যবসা স্থাপনে শ্রম অভিবাসন ও রেমিটেন্সের ভূমিকা বিষয়ে আরো পদ্ধতিগত গবেষণা প্রয়োজন। প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্সের অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় এর প্রবাহকে নিয়মিত বা আইনানুগ প্রক্রিয়াভুক্ত রাখার স্বার্থে রেমিটেন্স প্রেরণকারীদের জন্য বিভিন্ন প্রণোদনামূলক সহায়তা ও সেবামূলক ব্যবস্থা প্রণয়নের প্রয়োজন রয়েছে। সুপরিকল্পিত বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে বিদেশ থেকে রেমিটেন্স প্রেরণের ব্যয়ও হ্রাস করা সম্ভব।

লেখক: সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন