আমাদের সকলের বাবা ও মা সায়্যিদুনা আদম (আ.) ও তাঁর সঙ্গিনী হাওয়া (রা.)-কে আল্লাহ তাআলা যখন জান্নাত থেকে দুনিয়ায় নামিয়ে দিলেন, তখন যে দুআর বরকতে আল্লাহ তাআলা তাদের ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন, তাও ছিল এই ইস্তেগফার বা ক্ষমাপ্রার্থনার দুআ, ‘রাব্বানা যলামনা আনফুসানা ওয়া ইল্লামতাগফির লানা ওয়া তারহামনা লানাকুনান্না মিনাল খাসিরিন’। হে আমাদের প্রভু! আমরা তো আমাদের নিজেদের ওপর জুলুম করেছি। আপনি যদি আমাদের ক্ষমা না করেন, আমাদেরকে দয়া না করেন তবে তো আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ব! (সূরা আরাফ : ২৩)
এর বেশ পরে, তাদেরই এক সন্তান, সম্মানিত নবী সায়্যিদুনা ইউনুস (আ.) পড়েছিলেন এক কল্পনাতীত কঠিন সঙ্কটে। গভীর সাগরে এক মাছ, সে মাছের পেটের ভেতর নবী ইউনুস (আ.)! কয়েক স্তরের এ অন্ধকার থেকে যে দুআর বরকতে তিনি বেরিয়ে আসেন, তাও ছিল ইস্তেগফার বা ক্ষমাপ্রার্থনা। তিনি দুআ করেছিলেন, ‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনায য-লিমিন’। (হে আল্লাহ!) আপনি ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আপনি সকল ত্রুটি থেকে পবিত্র। নিশ্চয় আমি অপরাধী। (সূরা আম্বিয়া : ৮৭)।
ইস্তেগফার আমাদের পরকালকে যেমন সমৃদ্ধ করতে পারে, আমাদের দুনিয়ার জীবনকেও সুন্দর করতে পারে। ক্ষমাপ্রার্থনা কেবলই পাপ থেকে মুক্তি নয়, ক্ষমাপ্রার্থনা আমাদের সঙ্কট ও বিপদাপদ থেকেও মুক্তির হাতিয়ার। সহজ কথা, আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা চেয়ে কেউ যদি নিজের পাপগুলো ক্ষমা করিয়ে নিতে পারে, চোখের পানি ফেলে কেউ যদি ক্ষমাপ্রাপ্ত হতে পারে, তবে স্বাভাবিকভাবেই সে আল্লাহর প্রিয় বান্দায় পরিণত হবে।
আর আল্লাহর প্রিয় বান্দা যারা, তাঁর রহমত ও দয়া তাদেরকে দুনিয়া-আখেরাত সর্বত্র ঘিরে রাখবেই। তা-ই যদি হয়, তবে আর ভাবনা কীসের! প্রয়োজন কেবলই গোনাহের অভিশাপ থেকে মুক্তির। ইস্তেগফারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটি শব্দ-তওবা। শব্দদুটি প্রায় সমার্থক। ইস্তেগফার অর্থ কৃত গোনাহের জন্যে আল্লাহর কাছে অনুতাপ ও অনুশোচনার সঙ্গে ক্ষমা প্রার্থনা করা, আর তওবা অর্থ ফিরে আসা, পাপের পথ ছেড়ে পুণ্যের পথে ফিরে আসা, আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে আনুগত্যের দিকে ফিরে আসা, ভুল পথ ছেড়ে মহান প্রতিপালকের দিকে ফিরে আসা।
এ তওবা-ইস্তেগফার একজন মুমিনের বড় গুণ। গোনাহের অভিশাপ থেকে নিজেকে পবিত্র করার হাতিয়ার। মানবীয় দুর্বলতার কারণেই আমরা শিকার হই শয়তানের কুমন্ত্রণার। আর তখন বিভিন্ন গোনাহের কাজে জড়িয়ে পড়ি। সে গোনাহ থেকে মুক্তির পথই হচ্ছে তওবা ও ইস্তেগফার। ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায়, মানুষ কোনো পাপে লিপ্ত হওয়ার পর যদি সে তার ভুল বুঝতে পারে এবং এজন্যে সে কায়মনোবাক্যে মহান প্রভুর কাছে অনুতপ্ত হয়, তাহলে সে গোনাহ যত বড়ই হোক না কেন, তা ক্ষমা করে দেওয়া হয়।
পবিত্র কোরআনের আহ্বান কতটা সরল, দেখুন : (হে নবী,) তুমি বলে দাও, হে আমার বান্দারা! তোমরা যারা নিজেদের ওপর অবিচার করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ সমুদয় পাপ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি তো মহা ক্ষমাশীল, অত্যন্ত দয়ালু। (সূরা যুমার : ৫৩)।
তওবা করলে আল্লাহ তাআলা কি শুধু আমাদের গোনাহগুলো ক্ষমা করে দেন? এতটুকু হলেই তো যথেষ্ট ছিল। অবাধ্য গোলাম যদি ক্ষমা চেয়ে অবাধ্যতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারে, তবেই তো যথেষ্ট। কিন্তু তওবাকারী বান্দাদের প্রতি আল্লাহ তাআলার রহমত আরও অনেক ব্যাপক।
কয়েকটি বড় পাপের বর্ণনা দেয়ার পর তিনি ঘোষণা করেছেন : (এ সকল পাপে যে জড়াবে) কিয়ামতের দিন তার শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে এবং সেখানে সে স্থায়ী হবে হীন অবস্থায়। তবে তারা নয়, যারা তওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে। আল্লাহ তাদের পাপরাশিকে পুণ্য দিয়ে পাল্টে দেবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা ফুরকান : ৬৯-৭০)।
তবে তওবার এ প্রতিদান তাদের ভাগ্যেই জুটবে, যারা তওবা করবে খাঁটি মনে। অতীতের গোনাহের জন্যে অনুতপ্ত হয়ে ভবিষ্যতে সে অন্যায় আর কখনো না করার জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবে। এর পাশাপাশি কৃত অপরাধের দায়মুক্তির চেষ্টা করবে। বান্দার হক সংশ্লিষ্ট হলে তা আদায় করতে হবে কিংবা তার কাছ থেকে ক্ষমা করিয়ে নেবে।
সবশেষে ইস্তেগফার আমাদের দুনিয়ার জীবনকে কতটা সমৃদ্ধ করতে পারে, পবিত্র কোরআনে বর্ণিত এর একটি নমুনা উল্লেখ করছি : তোমরা তোমাদের প্রভুর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই তিনি মহাক্ষমাশীল। (ক্ষমাপ্রার্থনা করলে) তিনি তোমাদের ওপর মুষলধারায় বৃষ্টি বর্ষণ করবেন। তোমাদেরকে তিনি ধনসম্পদ ও সন্তানাদি দিয়ে সমৃদ্ধ করবেন। তোমাদের জন্যে তিনি বিভিন্ন রকমের বাগান ও অনেক নদ-নদী সৃষ্টি করে দেবেন। (সূরা নূহ : ১০-১২)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন