মুসলিম জাহানের বিভিন্ন ভূখণ্ড দীর্ঘ সময় অমুসলিম উপনিবেশ দ্বারা আক্রান্ত ছিল। সেই পরাধীনতার যুগে অমুসলিমরা আমাদের সমাজ-ব্যবস্থা, অর্থ-ব্যবস্থা ও বিচার-ব্যবস্থার যে নীতি ও কাঠামো প্রস্তুত করে দিয়েছে স্বাধীনতার পরও তা আমরা ত্যাগ করতে পারিনি। এর অনিবার্য প্রভাব পড়েছে আমাদের জাতীয় শিক্ষা-ব্যবস্থায়। শুধু তাই নয়, পরাধীনতার যুগে তারা আমাদের যে মানস-কাঠামো তৈরি করেছে আমরা এখনও তা বহন করছি। চিন্তা ও মূল্যবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণ কোনো কিছুতেই আমরা স্বকীয়তায় প্রত্যাবর্তন করতে পারিনি। তাই জাতি হিসেবে মুসলিম হয়েও আমাদের সমাজ-ব্যবস্থা, অর্থ-ব্যবস্থা ও বিচার-ব্যবস্থায় এর কোনো প্রভাব নেই। অতএব শিক্ষা-ব্যবস্থাতেও তা অপরিহার্যভাবেই অনুপস্থিত।
আমরা পারিনি আমাদের জাতীয় শিক্ষা-ব্যবস্থাকে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ঢেলে সাজাতে, এমনকি সফলভাবে ইসলামকে অন্তর্ভুক্ত করতেও আমরা সক্ষম হইনি। ফলে লক্ষ লক্ষ মুসলিম শিক্ষার্থী জ্ঞান-বিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করলেও চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিগত স্বাতন্ত্র্য অর্জনে সক্ষম হচ্ছে না। একজন অমুসলিম যেমন স্রষ্টা সম্পর্কে নিস্পৃহ হয়ে সৃষ্টিজগতকে পর্যবেক্ষণ করে আমাদের শিক্ষিত সম্প্রদায়ও কি তা-ই করেন না? ফলে সৃষ্টির অপার রহস্য উন্মোচিত হওয়ার পরও এই জ্ঞান তাদের স্রষ্টা পর্যন্ত পৌঁছতে সাহায্য করে না।
জীবন-দর্শন ও আচরিত জীবনব্যবস্থার ক্ষেত্রেও এ কথা সত্য। একটি সাহসী জাতির যে স্বাধীন নির্বাচন-শক্তি থাকা অপরিহার্য আমরা তার পরিচয় দিতে পারিনি। তাই পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে তাদের অবাস্তব ও অকল্যাণকর জীবন-দর্শনও আমরা গ্রহণ করে ফেলেছি। অথচ এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। পাশ্চাত্যের ভোগবাদ ও নাস্তিক্যবাদ কি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অপরিহার্য অনুষঙ্গ? এটা কি কোনোভাবেই সম্ভব নয় যে, আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে গ্রহণ করব, কিন্তু তা প্রয়োগ করব আমাদের নিজস্ব বিশ্বাস ও জীবন-দর্শনের আলোকে? অর্জিত জ্ঞানকে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বিন্যস্ত করে নিতে পারলে, সন্দেহ নেই, আমরাই হয়ে উঠতাম পৃথিবীর সেরা শক্তি। এটি নিছক একটি তত্ত্ব নয়, মুসলিম উম্মাহর অতীত ইতিহাস এরই জ্বলন্ত প্রমাণ।
আমাদের মাঝে সর্বোচ্চ সম্ভাবনা ছিল পৃথিবীর নেতৃত্ব গ্রহণের এবং বিশ্ব মানবতার কল্যাণে নিবেদিত হওয়ার, কিন্তু চিন্তাগত পরাধীনতা ও নির্বিচার পরানুকরণ সেই অমিত সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, তিক্ত হলেও সত্য এই যে, সভ্যতা, আধুনিকতা, প্রাগ্রসরতা ইত্যাদি বিভিন্ন অসার শব্দ ও অলিক কল্পনার দ্বারা দাসত্ব ও পরানুকরণকেই শিক্ষা ও শিক্ষা-ব্যবস্থার মৌলিক দর্শনরূপে গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে মুসলমানদের মানস-কাঠামো এমনভাবে গড়ে উঠছে যে, নিজ সম্ভাবনাকে অনুধাবন করাও তার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। রোগাক্রান্ত ব্যক্তি যখন রোগ সম্পর্কেই উদাসীন হয়ে যায়; তখন আরোগ্য লাভ অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ে।
তবুও শেষ কথা এই যে, হতাশার ঘন আঁধারেও আশার আলোকবিন্দু দেখা যাচ্ছে। অব্যাহত জুলুম-অত্যাচার এবং শোষণ ও বঞ্চনার কারণে মুসলিম জাহানে প্রাণের স্পন্দন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। একই সঙ্গে দীর্ঘ ভোগবাদী ও নিপীড়নমূলক জীবন-ব্যবস্থায় অতিষ্ঠ হয়ে অমুসলিম সমাজেও ইসলামী জীবনাদর্শের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছে। ওই সময়টা বোধহয় খুব বেশি দূরে নয় যখন ইসলামই হয়ে উঠবে বিশ্ব মানবতার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
আর ইসলাম যেহেতু সার্বজনীন আদর্শ তাই তা গ্রহণ করে অন্যান্য জাতি যদি আদর্শিক প্রতিযোগিতায় অগ্রগামীও হয়ে যায় তবে আশ্চর্য হওয়ার কোনো কারণ থাকবে না। তখন মুসলিম-সমাজে, মুসলিম পিতা-মাতার সন্তান হিসেবে অতি সহজে ইসলামী পরিচয় পেয়ে যাওয়া সত্ত্বেও যারা এর মূল্য অনুধাবনে সক্ষম হয়নি তারা ঈর্ষান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও তা কোনো সুফল বয়ে আনবে না।
কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও তবে আমি তোমাদের পরিবর্তে নিয়ে আসব অন্য এক সম্প্রদায়। অতঃপর তারা তোমাদের মতো হবে না।’ (সূরা মুহাম্মাদ : ৩৮)। আমাদের যাদেরকে আল্লাহ তাআলা মুসলিম-পরিচয় দান করেছেন তারা নিশ্চয়ই এই দুর্ভাগ্য বরণ করতে প্রস্তুত নই। সেক্ষেত্রে ইসলামী আদর্শের দিকেই আমাদের ফিরে আসতে হবে। সম্ভবত এখনো তার সুযোগ রয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন