নবীর মহাব্বত মুমিনের দ্বীন ও ঈমানের অংশ এবং তিনি ঈমানদারের জীবন ও কর্মের আদর্শ। নবী (সা.) এর মহব্বত ও ভালোবাসা কেবল আবেগের বিষয় নয়, দ্বীন ও ঈমানের বিষয়।
কোরআন মজীদের বিভিন্ন জায়গায় এ কথা বলা হয়েছে। এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, বলুন, তোমাদের পিতা, তোমাদের পুত্র, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের আত্মীয়-স্বজন এবং ওই সম্পদ, যা তোমরা উপার্জন করো এবং ব্যবসা-বাণিজ্য যার ক্ষতির আশঙ্কা তোমরা করো এবং ঐ ঘর-বাড়ি, যাতে তোমরা বসবাস করো, যদি তোমাদের কাছে আল্লাহর চেয়ে, তাঁর রাসূলের চেয়ে এবং তাঁর রাস্তায় জিহাদের চেয়ে অধিক প্রিয় হয়ে থাকে তাহলে অপেক্ষা করো আল্লাহর বিধান আসা পর্যন্ত। আল্লাহ সত্যত্যাগী সম্প্রদায়কে সৎপথ প্রদর্শন করেন না। (সূরা তাওবা : ২৪)
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা গ্রহণ করো আর যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক। আল্লাহকে ভয় করো, নিশ্চয়ই আল্লাহর শাস্তি অত্যন্ত কঠিন। (সূরা হাশর : ৭)। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ সমর্পিত চিত্তে মেনে নেওয়াই ঈমানের আলামত।
হাদীস শরীফে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার কাছে তার পিতা থেকে, পুত্র থেকে এবং সকল মানুষ থেকে অধিক প্রিয় না হই। (হযরত আনাস রা.-এর সূত্রে, বুখারী, কিতাবুল ঈমান : ১৫)।
কোরআন ও হাদীসের এই সুস্পষ্ট নির্দেশনা সর্বযুগে মুমিনের চেতনাকে জাগ্রত রেখেছে। তারা আল্লাহর নবীকে প্রাণের চেয়েও অধিক ভালোবেসেছেন এবং সমর্পিত চিত্তে তাঁর আনুগত্য করেছেন। অন্যদিকে ঈমানের দৌলত থেকে বঞ্চিত লোকেরাই আল্লাহর নবীকে ত্যাগ করেছে এবং বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তাঁর বিরোধিতা করেছে। তাই খোদাদ্রোহীদের রাসূল-অবমাননার ঘটনা নতুন নয়। আর তাদের পরিণতিও কারো অজানা নয়। স্বয়ং নবী (সা.) এর যুগেও রিসালত-অবমাননার ঘটনা ঘটেছে এবং নবী-প্রেমিক সাহাবীগণ তার সমুচিত জবাব দিয়েছেন।
ইহুদি-নেতা কাব ইবনে আশরাফ নবী (সা.)-এর শানে গোসতাখি করত এবং নিন্দা ও উপহাসমূলক কবিতা পাঠ করত। নবী (সা.) এর নবুওয়াতী নির্বাহী আদেশে মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা রা. তাকে খতম করেছেন। (সহীহ বুখারী : ৪০৩৭)।
ফতহে মক্কার সাধারণ ক্ষমার সময়ও ইবনে খাতালকে ক্ষমা করা হয়নি। সে আত্মরক্ষার জন্য কাবা ঘরের গিলাফ ধরে রেখেছিল। ওই অবস্থায় তাকে নবী (সা.) এর আদেশে হত্যা করা হয়। তার দুই দাসীকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, যারা ইবনে খাতাল রচিত কবিতা লোকদের আবৃত্তি করে শোনাত। (সহীহ বুখারী : ৪০৩৫; আলকামিল ইবনুল আছীর ২/১৬৯)।
নবী-যুগের এইসব ঘটনা প্রমাণ করে যে, তাওহীনে রিসালাত বা রাসূল-অবমাননা (সা.) একটি চরম অপরাধ, শরীয়তে যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। উম্মাহর চার ইমাম এ বিষয়ে একমত। আল্লামা শামী রাহ. বলেন, ‘রাসূল (সা.) সম্পর্কে কটূক্তিকারী ঈমান থেকে খারিজ ও হত্যার উপযুক্ত। চার ইমাম এ বিষয়ে একমত।’
ইসলামের বিজয়ের যুগে যখন মুসলমানদের আইন-আদালত অমুসলিমদের প্রভাব-প্রতিপত্তি থেকে মুক্ত ছিল তখন এ ধরনের অপরাধী মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হতো। এমনকি ইতিহাসে আছে যে, নবম শতকের মাঝামাঝিতে আন্দালুসে এক খ্রিস্টানের নেতৃত্বে কিছু লোক দলবদ্ধভাবে রাসূলের অবমাননায় লিপ্ত হয়েছিল। মুসলিম বিচারকরা সে সময় বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি। এদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কারণে স্পেন থেকে এই ফিতনা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। (দেখুন : তারীখে হিসপানিয়া ১/২০০)।
খ্রিস্টজগতের সাথে মুসলিমজাহানের দ্বন্দ-সংঘাতের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। খ্রিস্টান পাদরীদের ইসলাম-বিদ্বেষ এবং মুসলিম-বিরোধী প্রোপাগান্ডা খোদ খ্রিস্টান ঐতিহাসিকরাও স্বীকার করেন।
জে জে সান্ডারস লিখেছেন, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আরবের নবী (সা.)-কে খ্রিস্টানরা কখনো আগ্রহ ও সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখেনি। অথচ হযরত ঈসা (আ.)-এর নম্র ও নিষ্পাপ ব্যক্তিত্বই ছিল তাঁর আদর্শ। (ক্রুসেড আমলে) ইসলামের কারণে খ্রিস্টজগতের স্বার্থহানি এবং ক্রুসেডারদের অব্যাহত প্রোপাগান্ডার কারণে ইসলাম সম্পর্কে নিরপেক্ষ বিচার-বিবেচনার পরিবেশ ছিল না। ওই সময় থেকে আজ পর্যন্ত মুহাম্মাদ (সা.)-কে অন্যায়ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এবং ভিত্তিহীন কথাবার্তা প্রচার করা হয়েছে। সুদীর্ঘকাল যাবত এগুলোই হচ্ছে মুহাম্মাদ সম্পর্কে খ্রিস্টান জনসাধারণের বিশ্বাস। (আহদে উসতা কে ইসলাম কী তারীখ, ৩৪-৩৫)
ডব্লু মন্টগোমারি ওয়াট লেখেন, ‘মুশকিল এই যে, এই উগ্র সাম্প্রদায়িকতা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছি, যার শিকড় মধ্যযুগের যুদ্ধকালীন প্রোপাগান্ডার মাঝে প্রথিত। এখন তা প্রকাশ্যে স্বীকার করা উচিত। অষ্টম শতাব্দী থেকে ইউরোপের খ্রিস্টজগত ইসলামকে তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু ভাবতে থাকে। কারণ তাদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আধিপত্যের জন্য ইসলামই ছিল একমাত্র চ্যালেঞ্জ। তারা প্রতিপক্ষের চরিত্রহননের মাধ্যমে তাদের ধর্ম-বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। বিংশ শতকের মাঝামাঝিতেও এর জের অবশিষ্ট রয়েছে। (ইসলাম কেয়া হ্যায় পৃ. ২০১)।
খৃষ্ট জগতের এই বিদ্বেষ এখন আমরা উগ্রবাদী হিন্দুদের মাঝেও দেখতে পাচ্ছি। তারা এতদিন নানা অজুহাতে মুসলমানদের ওপর দমন পীড়ন চালিয়েছে। এখন তাদের ঔদ্ধত্ব এতটুকু বেড়ে গিয়েছে যে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল (সা.) ও উম্মাহাতুল মুমেনিনদের ব্যাপারে মিথ্যা অমূলক কুৎসা বলে বেড়াচ্ছে। ভারত সরকারের উচিত অনতিলম্বে এইসব কার্যকলাপ বন্ধ করে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা। অন্যথায় মুসলমানদের অন্তরে যে রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে তা বন্ধ হবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন