অর্থনীতিতে বাজেটের লক্ষ্য ব্যাপক। শুধু আয়ব্যয় সংক্রান্ত রাজস্ব নীতি দ্বারা সামষ্ঠিক অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এর সাথে রয়েছে কর্মসংস্থান, দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, মুদ্রানীতি, জাতীয় উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি ও আয় নিয়ন্ত্রণের মতো বিষয়সমূহ। গত ৯ জুন অর্থমন্ত্রী আ.হ.ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থ বছরে বাজেট পেশ করেছেন। করোনা মহামারীর ক্ষতি থেকে অর্থনীতি যখনই উত্তরণের দিকে যাচ্ছে, তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ আন্তর্জাতিক সরবরাহ ব্যবস্থার সংকট ও মূল্যস্থিতির নিয়ন্ত্রণহীনতা সকলকে ভাবিয়ে তুলেছে। অর্থমন্ত্রীর ঘোষিত ৬,৭৮,০৬৪ কোটি টাকার বাজেটে আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা ও ঘাটতি দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ টাকা। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭.৫ শতাংশ, মূল্যস্থীতির লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে ৫.৬ শতাংশ। বাজেট ঘোষণার আগে ও পরে গণমাধ্যম, অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও বিশ্লেষকগণ বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়া, পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। এসব প্রতিক্রিয়ার মাঝে বাজেটের ভালমন্দ বিষয়গুলো চ্যালেঞ্জের বিষয়, সমস্যা ও সম্ভবনার দিক উঠে আসে। অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তব্যে সমস্যাগুলো উল্লেখ করেছেন ঠিকই কিন্তু তা সমাধানের কৌশল, সমন্বিত পদক্ষেপ তেমন একটা স্পষ্ট করেননি। বিশেষত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেটে জোরালো পদক্ষেপ নেই। সাধারণত জনগণ, গরিব ও মধ্যবিত্ত শ্রেণী চায় সাধ্যের মধ্যে পণ্যদ্রব্য ক্রয়, স্বাভাবিক জীবন পরিচালনা ও আয় অনুসারে ব্যয় করতে। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেকেই মনে করেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই বাজেটের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ। অর্থমন্ত্রী তার বক্তব্যে আগামী অর্থবছরের ৬টি চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেন। এগুলো হলো, মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা, অভ্যন্তরীন বিনিয়োগ বাড়ানো, বিদেশি সহায়তা বাড়িয়ে অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়ন করা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়ন করা। মূল্য সংযোজন করের পরিমাণ ও ব্যক্তিকর দাতার সংখ্যা বাড়ানো, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান স্থিতিশীল রাখা।
বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যার বেশির ভাগ জোগান দেওয়া হবে দেশীয় ব্যাংক থেকে, যা ১,০৬,৩৩৪ কোটি টাকা। বিশেষ বিদেশি ঋণ ৯৫ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা, ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ ৪০০০১ কোটি টাকা এবং বিদেশি অনুদান দ্বারা হয়েছে ৩২৭১ কোটি টাকা। এতে সরকারের অভ্যান্তরীন ব্যাংক নির্ভরতা বেসরকারি খাতকে ভোগাবে। বেসরকারি বিনিয়োগ নিরৎসাহিত হবে। প্রস্তাবিত বাজেটে ভর্তুকি বাবদ ৮২ হাজার কোটি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার বিস্তারিত কিছু বলা হয় নাই। ভর্তুকির মধ্য থেকে যে সব খাতে অর্থ দেওয়া হবে সেসব খাত থেকে আয় আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বিশ^ অর্থনীতির টালমাটাল পরিস্থিতিতে আমদানি কমাতে হবে, বিনিয়োগও তেমন বাড়বে না, ঘাটতির পরিমাণও বড়, তার মধ্যে ঋণ পরিশোধ করে কীভাবে জিডিপি সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন হবে তা বোধগম্য নয়। বাজেটে কর্পোরেট কর তৃতীয় বারের মতো কমছে ২.৫ শতাংশ, সোনা আমদানি পর্যায়ে উৎসকর ৫ শতাংশের পরিবর্তে শুণ্য শতাংশ করা হয়েছে। রয়েছে স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের জন্য সু-খবর। স্টার্টআপ উদ্যোক্তার টার্ন ওভার কর হার ০.৬০ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক এক শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি স্টার্টআপ কোম্পানির আয়কর রির্টান দাখিল বাদে বাকী সব রিপোর্ট থেকে অব্যহতি এবং ৯ বছর পর্যন্ত লোকসান সমন্বয় করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ৫ কোটি টাকার বেশি জমার উপর আবগারী শূল্ক বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে ধনীদের উপর অতিরিক্ত করারোপ করা হলো। নীতিগত দিক থেকে এটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ হলেও ব্যাংকে সঞ্চয়ের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কৃষিও কৃষিজাত পণ্যে ভর্তুকি বৃদ্ধি করা প্রশংসনীয় উদ্যোগ, তবে কৃষি বিপণনের সমস্যা দূর করতে উদ্যোগ নিতে হবে। বাজেটের আরো কিছু ইতিবাচক দিক রয়েছে। যেমন: কিছু খাতে ভর্তুকি বাড়ানো হয়েছে, পোল্ট্রি ও লাইভস্টোকের ওপর ট্যাক্স কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেশীয় শিল্পকে সংরক্ষণের জন্য যে নীতি রয়েছে, তার জোরদারের কথা বলা হয়েছে। তবে ক্ষুদ্র মাঝারি খাতের দিকে বেশি নজর দারি করা উচিত। অনানুষ্ঠানিক খাতে জনসংখ্যার বড় একটি অংশ রয়েছে। তাদের আয়ের উৎসটি নিশ্চিত করা উচিত। মানুষের আয় বাড়লে বিদ্যমান কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সহজ হবে। বাজেটের সম্পদের বৈষম্য, আয় বৈষম্য কে কীভাবে সমন্বয় করা যায়, সেদিকে তেমন নির্দেশনা নেই। ব্যাংকিং সেক্টরকে ঢেলে সাজানোর উপর দেয়া উচিত ছিল। সুদের হারকে বাজার ব্যবস্থার উপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। সামষ্ঠিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতার জন্য শুধু রাজস্বনীতি নয়, মনিটারি পলিসিও দেখা উচিত। সরকারের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে মূল্যস্ফীতি ৬.৩ শতাংশ সেখান থেকে ৫.৬ শতাংশের লক্ষ্য কীভাবে অর্জন হবে তার কোন সুষ্পষ্ট নির্দেশনা বাজেটে পাওয়া যায়নি। ব্যয় প্রবাহ ও সংকোচনের সুযোগও কম।
যেসব উন্নয় প্রকল্প চলমান ও সম্পন্ন হওয়ার কাছাকাছি রয়েছে তাতে প্রয়োজনীয় অর্থ ছাড়িয়ে সময় মতো সম্পন্ন করা উচিত। প্রকল্প সময়মত সম্পন্ন না হলে ব্যয় বেড়ে যায়। এ ধরনের পুরোনোরীতি রোধ করতে হবে। সরকার ব্যাংকঋণ বেশি মাত্রায় নিলে তা ব্যক্তিঋণের উপর প্রভাব ফেলবে। দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের কল্যাণে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি যাতে যথাযথভাবে সঠিক ক্ষেত্রে পৌঁছানো যায় সে ব্যবস্থা করা উচিত। এই খাতে এবারেও বরাদ্দ বেড়েছে কিন্তু তা বর্তমান প্রেক্ষাপটের তুলনায় অপ্রতুল। দারিদ্রের দুষ্টচক্র ভাঙ্গার জন্য সহায়ক নয়। অর্থমন্ত্রী তার বক্তৃতায় বলেন, দেশে মধ্যবিত্ত বা তদূর্ধ্ব শ্রেণীর জনসংখ্যা প্রায় ৪ কোটির মতো। তারা অধিকাংশ আয়কর প্রদান করেন না। ফলে কর ফাঁকি রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা উচিত।
চলতি ২০২১-২০২২ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। গত মার্চ পর্যন্ত আদায় হয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার ৬৩৯ কোটি টাকা। জুন পর্যন্ত আদায় করতে হবে ১ লাখ ১৮ কোটি ৩৬১ কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত কত আদায় হয় তা দেখার বিষয়। নতুন অর্থবছর ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকার বেশি বিশাল এক রাজস্ব আদায়ের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের উপর করের চাপ বাড়বে। বাজেটের প্রস্তাবগুলো আরো কয়েকদিন যাবৎ আলোচনা-পর্যালোচনা হবে। তাতে আশা করা যায় সঠিক ও বাস্তবসম্মত রূপরেখা বেরিয়ে আসবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে গরিব মানুষের খাবার জোগান দেওয়া, মধ্যবিত্তদের আয় বর্ধন, চাকরির সুযোগ, বেকার ও কর্মহীনদের কর্মের ব্যবস্থা করা আবশ্যক। দুস্থ ও দুর্বল মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার আওতার বরাদ্দ আরো বাড়িয়ে তার যথাযথ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সকলের প্রত্যাশা। বিনিয়োগ না বাড়লে রাজস্ব আদায় বাড়বে না। আয়কর, ভ্যাট, কিংবা আমদানি-রপ্তানি যাই বলি না কেন সব কিছুর সাথে বিনিয়োগ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক ও ব্যাংকার
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন