শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সম্পাদকীয়

ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বাড়াতে হবে

আর কে চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ১৯ জুন, ২০২২, ১২:০২ এএম

অগ্নিকাণ্ডসহ যে কোনো বিপর্যয়কর ঘটনায় ভরসা হিসেবে বিবেচিত হন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে শিল্পায়ন হয়েছে আগের ২০ বা ৩০ বছরের চেয়ে বেশি। একের পর এক বহুতল ভবনও তৈরি হয়েছে। বেড়েছে জাতীয় অর্থনীতির পরিসর। অথচ, এ সময়ে যৌক্তিক কারণেই ফায়ার স্টেশনের সংখ্যা দ্বিগুণ হলেও বাড়েনি লোকবল। বাড়েনি কেমিক্যাল আগুন নেভানোর সক্ষমতা।

 

সীতাকুণ্ডের ডিপোতে তথ্য গোপন করায় আগুনের ভয়াবহতা বেড়েছে। নয়জন ফায়ার কর্মীর প্রাণহানিও ঘটেছে একই কারণে। রাসায়নিকের আগুন নেভানোর জন্য ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষিত ১৫০ জন ফায়ার কর্মী রয়েছেন। তাদের কাজের জন্য রয়েছে বিশেষ সরঞ্জামাদি ও পোশাক। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে এমন প্রশিক্ষিত ১১ জন ফায়ার কর্মী থাকলেও শিল্প এলাকা সীতাকুণ্ড ও পাশের কুমিরা ফায়ার স্টেশনে এ ধরনের প্রশিক্ষিত কেউ ছিলেন না। রাসায়নিকের আগুন নেভানোর জন্য বিদেশে প্রশিক্ষিত কর্মীদের নিয়ে ‘হ্যাজম্যাট’ নামের একটি ইউনিট রয়েছে ফায়ার সার্ভিসের। এ ধরনের আগুনের ক্ষেত্রে ‘কেমিক্যাল প্রটেকশন স্যুট’ নামের বিশেষ পোশাক পরে কাজ করেন তারা। সদর দফতরসহ বিভাগীয় শহরে রাখা হয় এ দলের সদস্যদের। নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে ঘটনাস্থলে গিয়ে নিকটস্থ ফায়ার স্টেশনের কর্মীরা সাধারণ আগুন হলে নিজেরা আগুন নেভানোর কাজ শুরু করবেন। তবে আগুন রাসায়নিক হলে অবশ্যই প্রশিক্ষিত হ্যাজম্যাট ইউনিটকে খবর দেবেন। সীতাকুণ্ডে আগুন নেভাতে যেসব ফায়ার কর্মী গিয়েছিলেন তারা মনে করেছিলেন হয়তো গার্মেন্ট পণ্যে আগুন লেগেছে। আগুন নেভাতে পানি ব্যবহার করার সঙ্গে সঙ্গে তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। কেমিক্যালের আগুন জানলে ফায়ার কর্মীরা সে ধরনের প্রস্তুতিই নিতেন। আগুন নেভাতে আসতেন প্রশিক্ষিত কর্মীরা। ফায়ার সার্ভিসের আধুনিকীকরণের প্রকল্প ১০ মাস স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ঝুলে থাকাও দুর্ভাগ্যজনক। ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বাড়াতে এ প্রকল্প সম্পর্কে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে গড়ে ১৬ হাজার। ইলেকট্রনিকস সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এর (ইএসএসএবি) এক তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর আগুনে মারা যায় ২৩৩ জন, আহত হয় প্রায় পাঁচ হাজার। এছাড়া প্রতি বছর গড়ে ৪ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকার মালামাল ভস্মীভূত হচ্ছে।

অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন, কেবল সচেতন হলেই অনেক অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ করা সম্ভব। ফায়ার সার্ভিসের কর্তাব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় বলেছেন, সচেতনতার অভাব এবং অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণে অনীহার কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ফায়ার সার্ভিস বিভিন্ন সময় পদক্ষেপ নিলেও তা যথেষ্ট প্রমাণিত হয়নি। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে জনসচেতনতা কার্যক্রম জোরাদার করতে হবে। বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে, বিড়ি-সিগারেট বা মশার কয়েলের আগুন সম্পর্কে মানুষকে সতর্ক করতে হবে। বিশেষ করে ঘনবসতি এলাকা, বস্তি, শিল্প-কলকারখানায় নিয়মিত মহড়া ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

বাংলাদেশে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এটাই প্রথম। এ ছাড়া কোনো অগ্নিকাণ্ডে ফায়ার সার্ভিসের এত কর্মীর নিহত হওয়ার ঘটনাও এর আগে ঘটেনি। কেন এমন ঘটল? আগুন নেভাতে গিয়ে আগুনে পুড়ে ও বিস্ফোরণে ফায়ার সার্ভিসের এত কর্মীকে কেন জীবন দিতে হলো?

মাত্র সাত দিন আগে কন্যাসন্তানের বাবা হয়েছিলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদস্য মো. মনিরুজ্জামান। ছুটি নিয়ে শিগগিরই মেয়েকে দেখতে আসার কথা ছিল। কিন্তু মেয়ের মুখ না দেখেই তাঁকে বিদায় নিতে হয়েছে। ফায়ার ফাইটারের উদ্ধার হওয়া লাশের মধ্যে রাঙামাটির মিঠু দেওয়ান শনাক্ত হয়েছেন। জীবন দিয়েছেন রাঙ্গামাটির আরেকজন নিপন চাকমা। কনটেইনার ডিপোর আগুন নেভাতে গিয়ে জীবন হারিয়েছেন মানিকগঞ্জের রানা মিয়া। নিহত হয়েছেন ফায়ার ফাইটার মো. আলাউদ্দিন। তাঁর তিন বছরের একটি ছেলে আছে। নিহত হয়েছেন রমজানুল ইসলাম রনি ও সীতাকুণ্ডের ফায়ার স্টেশনের কর্মী ইমরান মজুমদার। ইমরানের দুই সন্তান রয়েছে। স্ত্রী আবার পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।


কতগুলো নিবেদিতপ্রাণ মানুষের জীবনপ্রদীপ নিভে গেল। নিহত ফায়ার সার্ভিসকর্মীদের অনেকেই ছিলেন তাঁদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। এই পরিবারগুলো এখন কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? বিএম ডিপো আবার কর্মচঞ্চল হবে। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের এই সদস্যদের পরিবারগুলো কি আগের মতো প্রাণ ফিরে পাবে?

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহম্মেদ খান (অব.) এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের জানা ছিল না যে এখানে কী ধরনের দাহ্য পদার্থ আছে। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডে পানি বা নাড়া পড়লে বোমার মতো অগ্নিবিস্ফোরণ ঘটে। অন্য সাধারণ ঘটনার মতোই ফায়ার ফাইটাররা ক্লোজ ফাইটিং (কাছাকাছি গিয়ে আগুন নেভানো) করেছেন।’ তাঁর মতে, ‘সবার জানা-বোঝার ঘাটতির কারণে বড় খেসারত বা চরম মূল্য দিতে হয়েছে।’

ভুলটা কার? কে দেবে ভুলের খেসারত? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘এ ধরনের বিস্ফোরকভর্তি কনটেইনার কেন্দ্রীয় ডিপোতে না রেখে সম্পূর্ণ আলাদা ব্যবস্থায় রাখা দরকার ছিল। এসব বিস্ফোরক রাসায়নিক যাঁরা পরিবহন ও মজুদ করেছেন, তাঁদের ব্যবস্থাপনাটা সম্পূর্ণভাবেই ত্রুটিপূর্ণ ছিল।’ যেকোনো ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য ডিপোটিতে ইমার্জেন্সি রেসপন্স ব্যবস্থা ছিল কি না, তা খতিয়ে দেখার বিষয়েও গুরুত্ব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ধরনের কোনো ঘটনা ভবিষ্যতে আর ঘটবে না- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন