রমজান শেষে শাওয়াল মাসের আগমনের মাধ্যমে ‘আশহুরে হজ’ বা হজের মাসসমূহের সূচনা হয়েছে। কোরআন মাজিদে ইরশাদ হয়েছে : ‘হজ হচ্ছে নির্দিষ্ট মাস কয়েক।’ অর্থাৎ এই মাসগুলো হজের মওসুম। এই সময় হজের ইহরাম করা যায়। আর হজের নির্ধারিত কাজসমূহ সম্পন্ন হয় যিলহজের সেই দিনগুলোতে।
হজ ইসলামের অন্যতম রোকন। হাদীস শরীফে তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্যদান তথা ঈমানের পর যে চার ফরয ইবাদতকে ইসলামের ভিত্তি বলা হয়েছে হজ তার অন্যতম। কাজেই হজের গুরুত্ব উপলব্ধি করা প্রয়োজন। কোরআন মাজীদে সামর্থ্যবানদের ওপর হজ ফরয হওয়ার বিধান এসেছে খুবই তাকীদের সাথে। ইরশাদ হয়েছে : মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ওই গৃহের হজ করা তার অবশ্য কর্তব্য। আর যে এই নির্দেশ পালন করতে অস্বীকার করবে তার জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ দুনিয়াবাসীদের প্রতি সামান্যও মুখাপেক্ষী নন। (সূরা আলে ইমরান : ৯৭)।
সূরা আল ইমরানের এই স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন বাণী থেকেই হজের গুরুত্ব বোঝা যাচ্ছে। জানা যাচ্ছে এই অতি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের বিষয়ে শিথিলতা ও অবহেলার ভয়াবহতাও। কাজেই সামর্থ্যবান মুমিন নারী-পুরুষের কর্তব্য, এই গুরুত্বপূর্ণ ফরয ইবাদতটি আদায় করে ফেলা। এ ব্যাপারে অযথা কালক্ষেপণ না করা।
শয়তান নানাভাবে মানুষকে এই ইবাদত আদায়ের সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত করতে চায়। মানুষের মনে নানা রকম ওয়াসওয়াসা দেয়। শয়তানের ওয়াসওয়াসা হয়ে থাকে মানুষের অবস্থা-অনুসারে। একেক শ্রেণিকে একেকভাবে একেক যুক্তিতে বিভ্রান্ত করে। কারো মনে এই ওয়াসওয়াসা দেয় যে, এত অর্থ ব্যয় করে হজ্বে গিয়ে কী লাভ? এই অর্থ যদি সমাজের অসহায়-দুঃখীদের পেছনে খরচ করা হয় তাহলে তাদের দুঃখ মোচনের কত বড় ব্যবস্থাই না হয়?! অথচ এই কুমন্ত্রণা মদ-সিনেমা, নাচ-গান-কনসার্ট ইত্যাদি স্বভাব-চরিত্র বিধ্বংসী অপকর্মসমূহের ক্ষেত্রে শয়তান দেয় না; বরং ঐসকল ক্ষেত্রে অর্থ-ব্যয়কে নানা অপযুক্তিতে উৎসাহিত করে।
কে না বুঝবেন যে, কোনো ফরয কাজ বন্ধ রেখে নফল কাজ যুক্তিসঙ্গত নয়। বিশেষত যখন নফল কাজটি ফরয কাজ বন্ধ করার ওপর নির্ভরশীলও নয়। পক্ষান্তরে অন্যায় ও গর্হিত কাজ তো এমনিতেই বন্ধ করতে হবে। সেখানে ঐ কাজ বন্ধ করে সে অর্থ যদি সদকা করা হয় তাহলে তা আরো ভালো। কিন্তু শয়তান আল্লাহর বান্দাকে এভাবে সরল চিন্তার পরিবর্তে উল্টো ও বক্র চিন্তার সবক দিয়ে থাকে। হজ-কুরবানীর ক্ষেত্রে নফল দান-সদকার প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে আসে, কিন্তু গুনাহের পথে ব্যয়ের ক্ষেত্রে নীরব থাকে।
এখানে আরেকটি প্রশ্নও বিবেচনা করা যায়। আর তা হচ্ছে, হজের মতো মহান ইবাদতের তাওফীক না-হওয়া ইসলাম-বিমুখ লোকও সমাজে অনেক আছে। হজের মওসুমে তারা প্রত্যেকে গরিব-দুঃখীর পিছনে কত লক্ষ টাকা করে খরচ করেন শুনি! ওরা যে ওয়াসওয়াসাটা দ্বীনদার মুসলিমদের দিয়ে থাকেন সেটা যে কত বড় কপটতা তার দৃষ্টান্ত তো তারা নিজেরাই।
যাদের মনে ইসলামের বিধি-বিধানের প্রতি উপেক্ষার মনোভাব রয়েছে তারা শয়তানের এইসব কুমন্ত্রণায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। এটা তাদের দুর্ভাগ্যের ব্যাপার। ইসলামের বিধানের ব্যাপারে উপেক্ষা ও অনীহার ভাব মনে এলে ‘আউযুবিল্লাহ’ পড়ে আল্লাহর আশ্রয় নিতে হবে।
একশ্রেণির মানুষ এমনও আছেন, যারা ইসলামের বিধি-বিধানের ব্যাপারে আনুগত্যশীল। তাদেরকে শয়তান অন্যভাবে মন্ত্রণা দেয়। তাদেরকে বলে যে, হজ করা যত গুরুত্বপূর্ণ, হজ রক্ষা করা তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই এখন যুবক বয়সে হজ না করাই শ্রেয়। এখন তো তুমি হজ করে এসে পাক্কা মুসল্লী হতে পারবে না; কাজেই এখন নয়, অপারগ বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার আগে হজ করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না!
অথচ কে না বুঝবেন যে, এক দায়িত্ব পালন করতে না পারার আশঙ্কায় আরেক দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার কোনো মানে হয় না। হজ রক্ষা করতে না পারার আশঙ্কায় হজ না করাটা তো এরকমই একটা কাজ। আমাদের চিন্তা করতে হবে এভাবে যে, আমার যখন হজ আদায়ের সামর্থ্য আছে আমি তা আদায় করে ফেলি। এই ফরয দায়িত্ব থেকে দায়মুক্ত হয়ে যাই। এরপর অন্যান্য ফরয-ওয়াজিব বিধান পালনের ক্ষেত্রেও আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাব। যতটুকুই সফল হই তা আমার প্রাপ্তি, কিন্তু হজের ফরয বিধান তো পালিত হয়ে গেল।
এভাবে চিন্তা করলে বিষয়টি সহজ হয়ে যায়। এমনও তো হতে পারে, আল্লাহর এই বিধানটি পালনের বরকতে অন্যান্য বিধান পালনেরও তাওফীক হয়ে যাবে। মানুষ কি ভালো কাজ নিজের শক্তিতে করতে পারে? সে তা করে আল্লাহর তাওফীকে। কাজেই আল্লাহ তাআলা তাওফীক দিলে আমি হজ রক্ষাও করতে পারব।
সারকথা হচ্ছে, ইবাদত আদায়ের ক্ষেত্রে নানা প্রকারের ওয়াসওয়াসা মনে আসতে পারে, কিন্তু মুমিনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সে এইসকল ওয়াসওয়াসাকে দু’পায়ে দলে আল্লাহ তাআলার ইবাদত ও আনুগত্যের দিকে এগিয়ে যায়। আল্লাহর হুকুমের উপর কোনো যুক্তিকেই সে প্রাধান্য দেয় না; বরং সে যুক্তিসমূহকে বিচার করে আল্লাহর হুকুমের মানদণ্ডে। যে যুক্তি আল্লাহর হুকুম পালনে সহায়ক হয় সে সেই যুক্তিকে সুযুক্তি আর যা এর বিপরীত তাকে কুযুক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে।
মুমিনের চেতনার ভুবন জুড়ে এই বিশ্বাস জাগ্রত থাকে যে, আল্লাহ তাআলাই মানুষের সৃষ্টিকর্তা। অর্থ-বিত্তসহ জীবন যাপনের সকল উপায়-উপকরণেরও সৃষ্টিকর্তা। পৃথিবী ও পৃথিবীর সকল কিছু মানুষের জন্য তিনিই সৃষ্টি করেছেন। কাজেই মানুষের জীবন ও সম্পদ তাঁর আদেশে ব্যয় হওয়াই সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত। তাঁর আদেশ পালনে অর্থ ব্যয় কিছুতেই অপচয় নয়; বরং অর্থ-ব্যয়ের এটিই সবচেয়ে যথার্থ ও যুক্তিসঙ্গত খাত।
আল্লাহ তাআলা আমাদের ঈমানকে উজ্জীবিত করে দিন, আল্লাহমুখী চিন্তার তাওফীক দিন এবং তাঁর বিধানসমূহ শিরোধার্য করার ও আন্তরিকভাবে পালন করার তাওফীক দান করুন- আমীন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন