গণপরিবহনে বিশৃঙ্খলা ও যানজট রাজধানী ঢাকার অন্যতম নাগরিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। প্রায় দু’কোটি মানুষের এই শহরে জনসংখ্যার তুলনায় রাস্তার পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। গণপরিবহনের অপর্যাপ্ততা ও রাস্তায় নানাবিধ বিড়ম্বনার কারণে শহরের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর কাছে প্রাইভেটকার একটি অত্যাবশ্যকীয় অনুষঙ্গ হলেও মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণী মূলত পাবলিক ট্রান্সপোর্ট, ক্যাব অথবা সিএনজি অটোরিক্সার উপর নির্ভরশীল। আর সিএনজি চালকদের অপরাধপ্রবণতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও বেপরোয়া আইন লঙ্ঘনের ভুক্তভোগীও শহরের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। অটো চালক ও মালিকদের দাবীর মুখে বার বার ভাড়া বাড়িয়েও অটো রিক্সাগুলোকে নিয়ম-শৃঙ্খলার উপর প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব না হওয়ায় দুর্ভোগ পিছু ছাড়ছে না নগরবাসীর। বৈধ কাগজপত্র ও লাইসেন্স ছাড়াই অন্তত ১০ হাজার অটোরিক্সা চলছে ঢাকায়। অবৈধ অটোরিক্সা এবং অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের সাথে জড়িত সিন্ডিকেটেড অটো রিক্সাচালকদের বিরুদ্ধে বিআরটিএ’র পক্ষ থেকে মাঝে মধ্যে মোবাইল কোর্ট বসিয়ে অভিযান পরিচালিত হলেও অবস্থার কোন বাস্তব পরিবর্তন নেই বললেই চলে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের অব্যাহত মূল্য হ্রাসের মধ্যেও গত বছরের শেষপ্রান্তে সিএনজি অটোরিক্সা চালক-মালিকদের দাবীর প্রেক্ষিতে আরেকদফা ভাড়া বাড়ানো হয়। আশা করা হচ্ছিল, এবার সিএনজি অটোরিক্সা একটি নিয়ম-শৃঙ্খলায় আসবে। আদতে তা হয়নি। সিএনজি চালকদের অবস্থা এখনো তথৈবচ।
যে কোন দেশে ট্রাফিক এবং নগর পরিবহন ব্যবস্থা নগর জীবনের অন্যতম দর্পণ। প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে সময়মত কর্মস্থলে যাওয়া এবং সন্ধ্যায় নিরাপদে ঘরে ফিরে যাওয়ার নিশ্চয়তা নগরবাসীর অন্যতম নাগরিক অধিকার। স্বল্প আয়ের চাকুরে-শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে প্রতিদিন সিএনজি অটোরিক্সা ব্যবহার হয়তো সম্ভব নয়। তবে গণপরিবহনের অব্যবস্থাপনা ও অপ্রতুলতার কারণে যাতায়াতের প্রয়োজনে কখনো কখনো অটোরিক্সায় উঠতেই হয়। আর যেসব মধ্যবিত্ত পরিবারের পক্ষে একটি প্রাইভেটকার কেনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করার সামর্থ্য নেই তারাও বাধ্য হয়ে সিএনজি অটোরিক্সা ব্যবহারে বাধ্য হন। মিটারে নির্ধারিত ভাড়ার স্থলে দ্বিগুণ বা তারও বেশী ভাড়া দাবী করে অটোরিক্সার উপর নির্ভরশীল নগরবাসী যাত্রীদের অনেকটা জিম্মি করে রাখা হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে। গতবছর নভেম্বরে নতুন বর্ধিত ভাড়ার উপর সিএনজি অটোরিক্সার উপর নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ঢাকায় মোবাইলকোর্ট বসিয়ে অভিযান পরিচালিত হওয়ার পর অবস্থার কিছুটা ইতিবাচক পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গিয়েছিল। তবে সে পরিবর্তনের রেশ ছিল ক্ষণস্থায়ী ও আংশিক। গতকাল একটি দৈনিকে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়, ঢাকার সিএনজি অটোরিক্সা চালকরা এখনো নিয়ন্ত্রণহীন। এদের বেশীরভাগই মিটারে চলাচলের বাধ্যবাধকতা মানছে না, যাত্রীদের কাছ থেকে দ্বিগুণের বেশী ভাড়া আদায় করে নিচ্ছে। সবচেয়ে দুর্ভোগের বিষয় হচ্ছে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তার পাশে বসে থাকলেও নিজেদের পছন্দমত না হলে তাড়া যেতে চায় না। অথচ শহরের যে কোন প্রান্তে মিটারে নির্ধারিত ভাড়ায় চলাচল করতে তারা আইনত বাধ্য।
শহরের রাস্তায়, প্রায় প্রতিটি পাবলিক স্কোয়ারে ও সিগনালে ট্রাফিক পুলিশ থাকলেও পুলিশ ও ট্রাফিক সার্জেন্টরা লাইসেন্স ও রুটপারমিটহীন চালকদের বিরুদ্ধে মামলা করে অথবা নগদ ঘুষের বিনিময়ে রফাদফা করলেও ভাড়া ও পাবলিক সেইফটি বিষয়ক আইনগত নিরাপত্তার প্রশ্নে তাদের যেন তেমন কোন গরজ নেই। শুধু অটোরিক্সা বা টেক্সিক্যাবই নয় এমনকি লোকাল বাসগুলোও নির্দিষ্ট ভাড়ার অতিরিক্ত টাকা আদায় করতে নানা রকম শর্ত ও কায়দা-কৌশল গ্রহণ করে থাকে। এছাড়া গণপরিবহনের আকৃতি-প্রকৃতি ভেদে আসনসংখ্যা,পরিচ্ছন্নতা ও যাত্রী নিরাপত্তার ইস্যুগুলো যেন ধর্তব্যের বাইরে। এ নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। প্রতিদিন কোটি মানুষের যাতায়াতে ব্যবহৃত গণপরিবহনের পরিচ্ছন্নতাও জনস্বাস্থ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিশেষত নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ মানুষের যাতায়াতের জন্য সিএনজি অটোরিক্সা ও টেক্সিক্যাবগুলোকে নিয়ম-শৃঙ্খলায় প্রতিষ্ঠিত করা জরুরী। কোন কোন সিএনজি অটোরিক্সায় ডিএমপি’র অভিযোগ মোবাইলফোন নম্বর লেখা থাকলেও বিপদে পড়া যাত্রীদের প্রতিকার পাওয়ার দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। ঢাকার অভ্যন্তরে এবং হাইওয়েতে বিদ্যুতচালিত ইজিবাইক নিষিদ্ধ হলেও শহরতলিতে ও সারাদেশে হাজার হাজার ইজিবাইক চলছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত ইজিবাইকের চালকরা পুলিশ ও স্থানীয় সিন্ডিকেটকে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা চাঁদা দিতে বাধ্য হচ্ছে। রিক্সা ও ইজিবাইকের মত গণপরিবহনের উপর লাখ লাখ মানুষ নির্ভরশীল। এসব পরিবহন নিষিদ্ধ করে পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় সিন্ডিকেটেড চাঁদাবাজির সুযোগ বৃদ্ধি করা হয়েছে মাত্র। গণপরিবহন ও ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত সমাজের দুর্ভোগ লাঘবে সিএনজি অটোরিক্সা ও টেক্সিক্যাব চালকদের অন্যায় আচরণ ও আইনগত বাধ্যবাধকতা পালনে আরো কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। আইন অমান্য করে পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতি বন্ধ না হলে নিয়ম-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব নয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন