আকাশ পথে যাতায়াতে দেশের প্রধান বিমানবন্দর হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এ বিমানবন্দরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কয়েকটি শক্তিশালী চোরাচালান সিন্ডিকেট। এসব সিন্ডিকেটের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেও থেমে নেই চোরাচালান। প্রতি মাসেই আসছে স্বর্ণের বড় বড় চালান। এসব ঘটনায় মাঝে মধ্যে স্বর্ণ বহনকারীরা গ্রেফতার হলেও মূল হোতারা রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত ৫ বছরে স্বর্ণ চোরাচালানের অভিযোগে ২৩৩টি মামলায় ২৬১ জন গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু এদের অধিকাংশই জামিনে বের হয়ে আবারো স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ছে।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানান, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, কাস্টমস, সিভিল এভিয়েশনের কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী বিমানবন্দরে চোরাচালানে জড়িত রয়েছে। তাদের সহযোগিতায় চলছে স্বর্ণ চোরাচালান। পাচারকারী চক্র বাংলাদেশকে স্বর্ণ পাচারের ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। সিভিল এভিয়েশনের এক কর্মকর্তা ডিবি পুলিশকে জানিয়েছে, প্রতি মাসে পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে দেশের বাইরে থেকে অবৈধভাবে নিয়ে আসা স্বর্ণ হজরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গোপনে বের করে দেয় সিভিল এভিয়েশনের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একাধিক সিন্ডিকেটের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে মাসিক এই চুক্তিতে নিরাপদে অবৈধভাবে নিয়ে আসা স্বর্ণ বিমানবন্দরের বাইরে বের করে দেয়। এ চক্রের সাথে জড়িত রয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী। এদের কারণে কথিত কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেও থেমে নেই চোরাচালান।
জানা যায়, বিমানবন্দরে চোরাচালানে জড়িত ৭০ জনের সিন্ডিকেটের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ করে বিমান, সিভিল এভিয়েশন ও কাস্টমসের কিছু প্রভাবশালী কর্মকর্তা। এদের সাথে আন্তর্জাতিক পাচারকারীদের যোগাযোগ রয়েছে। একটি গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে এ সিন্ডিকেটের সদস্যদের নাম ওঠে এসেছে। গোয়েন্দারা এদের নামে তালিকা করলেও এদের গ্রেফতার করতে পারছে না নেপথ্যের প্রভাবশালী কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও গডফাদারদের কারণে।
ডিবি কর্মকর্তা আরো বলেন, শুধু একটি সিন্ডিকেট নয়, কয়েকটি সিন্ডিকেট ও বিমানবন্দরের কোন কোন কর্মকর্তা কত টাকার বিনিময়ে স্বর্ণ বের করে দেন, সে বিষয়েও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখন অনেকের নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, আমরা এসব কর্মকর্তাকে গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে এনেছি। তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই শেষে অভিযান চালানো হবে।
সিভিল এভিয়েশনের জুনিয়র প্রটোকল অফিসার হাফিজুর রহমানকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে। হাফিজুর রহমান গোয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে জানান, প্রতি মাসে বিমানবন্দর থেকে স্বর্ণ বাইরে বের করে দিতে তিনি কয়েকটি চক্রের কাছ থেকে পাঁচ লাখ করে টাকা নিতেন। ১৩ বছরের চাকরি জীবনে অসংখ্যবার তিনি বিমানবন্দর থেকে স্বর্ণ বাইরে বের করে দিয়েছেন। আরো অনেক কর্মচারী পাঁচ লাখ টাকার চুক্তিতে স্বর্ণ বাইরে বের করে দেয়ার কাজ করেন বলেও জানান তিনি। হাফিজুরের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা পুলিশ বিমানবন্দরে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে বলে জানান মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গত ৫ বছরে যেসব চোরাই স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়েছে এর প্রতিটি ঘটনায় মামলা হয়েছে। কিন্তু এসব মামলায় নেপথ্যের গডফাদার বা প্রকৃত চোরাচালানী গ্রেফতার হয়নি একজনও। ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এসব ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয় ২৩৩টি। এছাড়া স্বর্ণ চোরাচালানের সময় হাতেনাতে গ্রেফতার হয়েছেন ২৬১ জন। তবে এদের অধিকাংশই আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হয়ে এসেছেন।
জানা যায়, ২০১৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ৩৫ টি মামলা হয়, গ্রেফতার করা হয় ৩১ জনকে। ২০১৫ সালে ৫৫ টি মামলা হয়, স্বর্ণসহ গ্রেফতার করা হয় ৮৭ জনকে। ২০১৪ সালে ৬২ টি মামলা হয়, গ্রেফতার করা হয় ৩২ জনকে। ২০১৩ সালে গ্রেফতার করা হয় ৮১ জনকে। মামলা দায়ের করা হয় ৬১টি। ২০১২ সালে গ্রেফতার করা হয়েছিল ১৬ জনকে আর মামলা দায়ের করা হয়েছিল ১১টি। ২০১১ সালে স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনায় মোট ৯টি মামলা দায়ের করা হয়, গ্রেফতার করা হয় ১৪ জনকে।
এছাড়া ২০১০ সালে ৫ জন, ২০০৯ সালে সাড়ে ৫ কেজি স্বর্ণসহ ৪ জন, ২০০৮ সালে ২২ কেজি স্বর্ণসহ ১৯ জন, ২০০৪ সালে ২৬ কেজি স্বর্ণসহ ৩ জন, ২০০৩ সালে ৮৫টি স্বর্ণের বার ও ২৭ কেজি স্বর্ণসহ ৯ জন, ২০০২ সালে ১১৮ কেজি স্বর্ণসহ ৩ জন, ২০০১ সালে ৯৫ কেজি স্বর্ণসহ ১০ জন, ২০০০ সালে ৫ কেজি স্বর্ণ পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিবি’র এক কর্মকর্তা জানান, হজরত শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দরকে কেন্দ্র করে বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার সদস্য সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। এ সিন্ডিকেটের সদস্যদের মধ্যে রয়েছে বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সিভিল এভিয়েশনের অসাধু চক্র। এছাড়া কাস্টমসসহ বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা বিমানবন্দরে স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত। ওই কর্মকর্তা আরো জানান, সিভিল এভিয়েশনে দৈনিকভিত্তিক মাস্টার রোলে নিরাপত্তা প্রহরী পদে চাকরি করেন এমন কর্মচারীদের রয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি ও দামি গাড়ি। সিভিল এভিয়েশনের ড্রাইভার, ট্রলিম্যান, ক্লিনার, বিমানের লোডার, ড্রাইভার এমন কি লাগেজপত্র আনানেয়া করে এমন কর্মচারীরাও কোটিপতি। শুধু যে এসব কর্মচারীই অসাধু তা কিন্তু নয়, তাদের কিছু বসও আছেন যারা প্রচুর অবৈধ অর্থ-বিত্ত ও সম্পদের মালিক। এ অসাধু চক্রের অবৈধ অর্থের উৎস হলো স্বর্ণসহ বিভিন্ন চোরাচালানে সহযোগিতা করা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত রয়েছে ৭০ জনের সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। বিমানবন্দরে স্বর্ণ আনা এবং সেখান থেকে নির্বিঘেœ বের করে দেয়ার দায়িত্ব পালন করে এ সিন্ডিকেট। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক স্বর্ণ পাচারকারী চক্রের সাথেও রয়েছে এদের সুসম্পর্ক। বিমানবন্দরে কর্মরত এ সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রতি মাসে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত পাচ্ছে। স্বর্ণ পাচারকারীরা টাকার বিনিময়ে বিমানবন্দরে কর্মরত ওই সিন্ডিকেট সদস্যদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছে। মাঝে-মধ্যে স্বর্ণের চালান আটক হলেও কখনো ধরা পড়ে না নেপথ্যের গডফাদাররা। ফলে বন্ধ হচ্ছে না স্বর্ণ চোরাচালান। আন্তর্জাতিক পাচারকারী চক্র ট্রানজিট রুট হিসেবে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরকে ব্যবহার করছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত গ্রেফতারকৃতরা এ ধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্য জানিয়েছে।
বিমানবন্দর কাস্টসম সূত্র জানায়, চোরাচালানে আসা বিভিন্ন সময়ে উদ্ধারকৃত ১ হাজার ২৭০ কেজি স্বর্ণ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিয়েছে কাস্টমস বিভাগ। ২০০৯ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ৫ বছরে এই পরিমাণ স্বর্ণ ব্যাংকে জমা দেয়া হয়েছে। যা বিমানবন্দর থেকে উদ্ধার করা হয়।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক মইনুল খান বলছেন, বিমানবন্দরে কর্মরত কিছু অসাধু ব্যক্তি স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত। তিনি বলেন, গত বছর ২৪ জুলাই উদ্ধারকৃত ১২৪ কেজি স্বর্ণ চোরাচালানে বিমানের কর্মকর্তারা জড়িত। অভিযুক্ত ১৪ জনের মধ্যে ১০ জনই বিমানের কর্মকর্তা- কর্মচারী। এর আগে গত বছর ২৬ এপ্রিল ১০৫ কেজি স্বর্ণ বিমান থেকে উদ্ধার করা হয়। এই চোরাচালানের সাথে অন্যান্যের সাথে বিমানের প্রকৌশল বিভাগ জড়িত রয়েছে। এছাড়া বিমানবন্দরের আরো কয়েকটি সংস্থার কর্মকর্তা কর্মচারীরা স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত রয়েছে।
গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, স্বর্ণ পাচারকারীরা বিমানবন্দরে যেসব কর্মকর্তাদের যোগসাজশে স্বর্ণ পাচার করে, এর মধ্যে হাফিজুর অন্যতম। গত বছর এপ্রিল মাসে ২০ কেজি স্বর্ণের বার উদ্ধার ও মামলার পর তার নাম ওঠে আসে, এরপর থেকে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন। কর্মকর্তারা জানান, বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানোর পর গোপন তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা পুলিশ জানতে পারে রাজধানীর মিরপুর থেকে হাফিজুরকে ১৬ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করা হয়। স্বর্ণ পাচারে সহযোগিতা করে বাড্ডার হোসেন চেয়ারম্যানের এই সিন্ডিকেটের কাছ থেকে মাসিক পাঁচ লাখ টাকা নিতেন। এই সিন্ডিকেটও অসংখ্যবার স্বর্ণ পাচার করেছে বলে গোয়েন্দাদের জানান হাফিজুর। তবে কতদিন ধরে হাফিজুর এই কাজ করছেন এ বিষয়ে সঠিক কোনো উত্তর দিতে পারেননি তিনি। স্বর্ণ পাচারকারী সিন্ডিকেট ও পাচার প্রক্রিয়া সম্পর্কে গোয়েন্দাদের কাছে চাঞ্চল্যকর তথ্য থাকলেও তদন্তের স্বার্থে সেসব তথ্য প্রকাশ করেনি।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, গত বছরের ২০ এপ্রিল এই চক্রটি সিঙ্গাপুর থেকে স্বর্ণের চালান নিয়ে আসে। ওই দেশে থাকাবস্থায় তারা হাফিজুরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এ সময় হাফিজুর তাদের জানান, ওই সময় তার ডিউটি ছিল না। তবে সমস্যা হবে না মোবারক নামের সিভিল এভিয়েশনের আরেক কর্মকর্তা তাদের পার হতে সাহায্য করবেন। তারা সিঙ্গাপুর থেকে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের এসকিউ ৪৪৬ ফ্লাইটে উঠার পর বাংলাদেশের শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ বিষয়টি টের পায়। এরপর শাহজালাল বিমানবন্দরে ফ্লাইট থেকে নামার পর গ্রিন চ্যানেলে পৌঁছলে সেখান থেকেই তাদের চারজনকে আটক করা হয়। তবে ওই চারজন আটক হওয়ার খবর পাওয়ার পরপরই গ্রেফতার এড়াতে হাফিজুর আত্মগোপন করেন।
পুলিশ সদর দপ্তর ও আদালত সূত্র জানায়, গত ৩২ বছরে স্বর্ণ চোরাচালান মামলায় মাত্র ১৮ জনের সাজা হয়েছে। তবে ওই সময়ের মধ্যে স্বর্ণ চোরাচালানের সময় হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়েছে ৩৫০ জনকে। তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছে ৯২০ কেজি স্বর্ণ। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩ শতাধিক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন