যমযম। কী মধুর নাম! কী সুন্দর উচ্চারণ! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তম পানি। এ পানি শুধু পিপাসাকাতর কলিজাকেই শীতল করে না, হৃদয় ও আত্মাকেও এক অপার্থিব প্রাপ্তিতে পরিতৃপ্ত করে। দেহ ও মনকে সজীব করে তোলে। মক্কা নগরীতে আল্লাহর এক মহা নিদর্শন হলো যমযম কূপ। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভূমিতে আল্লাহ তাআলা এ কূপ উৎসারিত করেছেন।
পরবর্তীতে যমযমকে কেন্দ্র করেই আবাদ হয়েছিল পবিত্র মক্কা নগরী। পানি না থাকায় ইতঃপূর্বে এখানে কোনো মানুষ বসবাস করত না। এ কূপ উৎসারিত হওয়ার পর ইয়ামানের জুরহুম গোত্র খবর পেয়ে এখানে আসে এবং হাজেরা রা.-এর অনুমতি নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ইসমাঈল আ. বড় হয়ে এ গোত্রেই বিবাহ করেন এবং ধীরে ধীরে পবিত্র মক্কা নগরী গড়ে ওঠে। তাই বলা যায়, যমযম কূপই ছিল বর্তমান মক্কা আবাদ হওয়ার প্রধান অবলম্বন।
যমযম চিরবহমান। আজ পর্যন্ত এর পানি কখনো শুকায়নি। হাজার হাজার বছর ধরে কোটি কোটি হাজীর তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের পিপাসা মিটিয়ে আসছে। তারা নিজেরা পান করছেন এবং বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন পৃথিবীর দূর-দূরান্তের জনপদে। ফলে মক্কায় না গিয়েও সারা বিশে^র মুসলিম এ পানির বরকত ও কল্যাণ লাভে ধন্য হচ্ছে। এ পানির যে গুণ-বৈশিষ্ট্য এবং বরকত ও কল্যাণ হাজার বছর আগে ছিল ঠিক সেই গুণ-বৈশিষ্ট্য ও বরকত আজ হাজার বছর পরও বিদ্যমান। যুগ যুগ ধরে আল্লাহর কুদরতের মহা নিদর্শনরূপে স্থায়ী হয়ে আছে যমযম কূপ।
যমযম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পানি : হযরত ইবনে আব্বাস রা. নবীজী (সা.) থেকে বর্ণনা করেন : যমযম ভূপৃষ্ঠের শ্রেষ্ঠ পানি। এতে রয়েছে খাদ্যের বৈশিষ্ট্য ও রোগ থেকে মুক্তি। (আলমুজামুল কাবীর, তবারানী : ১১১৬৭)।
যমযম ধারণ করে আছে ত্যাগ ও বিসর্জনের এক ইতিহাস। এ পানি যেন পানি নয়; বরং হাজেরা-ইবরাহীম-ইসমাঈলের (আলাইহিমুস সালাম) ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহর রহমতের ঝর্ণাধারা। আল্লাহ তাআলার হুকুমে হযরত ইবরাহীম রা. স্বীয় পুত্র ইসমাঈল আ. ও স্ত্রী হাজেরা রা.-কে জনমানবহীন মক্কায় রেখে রওনা হলেন। ইবরাহীম আ. যখন সেখান থেকে চলে আসতে লাগলেন, তখন হাজেরা রা. তাকে বারবার বলতে লাগলেন- এমন জনমানবহীন মরু প্রান্তরে আমাদের একাকী রেখে আপনি চলে যাচ্ছেন?! কিন্তু তিনি কোনো সাড়া দিচ্ছিলেন না।
অবশেষে হাজেরা (রা.) বললেন : আল্লাহই কী আপনাকে আমাদের এখানে রেখে যেতে বলেছেন? তিনি উত্তরে বললেন, হ্যাঁ। হাজেরা (রা.) তখন (ঈমানদৃপ্ত কণ্ঠে বললেন,) তাহলে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না।
‘তাহলে আল্লাহ আমাদের ধ্বংস করবেন না।’ এ উত্তরের মাধ্যমে হাজেরা (রা.) যেন বলতে চাইলেন, এ যখন আল্লাহর হুকুম তখন তা শিরোধার্য। যে কোনো ত্যাগ-বিসর্জনের বিনিময়ে তা আমি শিরোধার্য করছি। আর আল্লাহর হুকুমের সামনে যে নতশির হয় তাকে কি আল্লাহ ভুলে যাবেন? আপনার উপস্থিতি ছাড়াই তিনি আমাদের ভালো রাখবেন, তিনিই হবেন আমাদের সহায়।
ইবরাহীম (আ.) চলে গেলেন। তার কি মন চাচ্ছিল- এ নির্জন মরুভূমিতে স্ত্রী-পুত্র রেখে যেতে? না, তিনিও উৎকণ্ঠিত হচ্ছিলেন। অজানা উৎকণ্ঠা তাকে বিচলিত করে ফিরছিল। তাই তো যখন তিনি তাদের দৃষ্টিসীমার আড়াল হলেন কাবা অভিমুখী হয়ে দুআ করলেন, স্ত্রী-পুত্রকে আল্লাহর হাওয়ালা করলেন; তিনি বললেন : হে আমাদের প্রতিপালক! আমি আমার বংশধরের কতককে বসবাস করালাম অনুর্বর উপত্যকায় তোমার গৃহের নিকটে!... (সূরা ইবরাহীম : ৩৭)।
চারদিকে ধু-ধু মরুভূমি। নির্জন প্রান্তর। কোনো লোকজন নেই। দৃষ্টির শেষ সীমা পর্যন্ত শুধু বালুর ঢেউ। কেমন ভয় ও একাকীত্ব, উৎকণ্ঠা ও অস্থিরতা তখন ছিল হাজেরা (রা.)-এর মনে তা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। তবুও তিনি সন্তুষ্ট মনে বরণ করে নিয়েছেন সবকিছু। সমর্পিত হয়েছেন আল্লাহর হুকুমের সামনে।
রেখে যাওয়া সামান্য খাদ্য ও পানীয় শেষ হয়ে গেলে দুগ্ধপোষ্য শিশু ইসমাঈল (আ.) তৃষ্ণায় ছটফট করছিলেন। এমতাবস্থায় হাজেরা (রা.) পানির সন্ধানে ব্যাকুল হয়ে দৌড়াতে থাকেন। একবার সাফায় যান আবার মারওয়ায়। না! পানির কোনো চিহ্ন নেই, কোনো মানুষও দেখা যাচ্ছে না। আবার সাফায় যান। এভাবে সাফা-মারওয়া পাহাড়দ্বয়ে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করেন। এরপরও পানি না পেয়ে অস্থির হয়ে পড়েন। পানির কোনো সন্ধান নেই। কোনো উপায় নেই। এখন আল্লাহ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। আল্লাহর রহমতই এখন একমাত্র ভরসা। ঠিক তখনই যমযম রূপে নেমে আসে আল্লাহর রহমত। আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত ফেরেশতার পাখার আঘাতে সৃষ্টি হয় এক অলৌকিক কূপ। বের হয়ে আসতে লাগল পানির ফোয়ারা!
হাজেরা (রা.) তখন পানির স্রোতধারা আটকানোর জন্য চারদিকে বাঁধ তৈরি করতে লাগলেন। রাসূল (সা.) বলেন : আল্লাহ তাআলা উম্মে ইসমাঈলের ওপর রহম করুন। তিনি যদি যমযমকে এভাবে ছেড়ে রাখতেন তাহলে তা প্রবহমান ঝর্ণায় পরিণত হতো। (দ্র. সহীহ বুখারী : ৩৩৬৪)।
যমযম আমাদের ত্যাগ ও বিসর্জনের শিক্ষা দেয়। আল্লাহর হুকুম পালনার্থে পৃথিবীর সমস্ত সুখ ও আনন্দ এবং নিজের ইচ্ছা ও চাহিদাকে কুরবান করে আল্লাহর জন্য পুরোপুরি সমর্পিত হওয়ার চেতনায় উজ্জীবিত করে তোলে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন