ফ্যাটি লিভারের চিকিৎসা করাতে প্রতিবেশী দেশ ভারতে যান মিঠু। সেখানে গিয়ে দেখতে পান কিডনির চাহিদা। দেশে ফিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গড়ে তোলেন কিডনি পাচারকারী চক্র। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অর্থের লোভ দেখিয়ে কিডনি ডোনারদের প্রথমে নিয়ে আসতেন ঢাকায়। কিডনি রোগীর আত্মীয় সাজিয়ে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তাদের পাঠানো হতো ভারতে। সেখানে কিডনি প্রতিস্থাপন শেষে দেশে ফিরে টাকা চাইলেই দেয়া হতো হুমকি। কিডনি পাচারকারী এ চক্রের প্রধান শহিদুল ইসলাম মিঠুকে জিজ্ঞাসাবাদে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে র্যাব। এ চক্রের আরও চার সদস্যকে রাজধানীর ভাটারা, বনশ্রী ও মিরপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। গতকাল
বুধবার কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য জানান র্যাব-১ এর অধিনায়ক আবদুল্লাহ আল মোমেন।
তিনি বলেন, ইতোপূর্বে র্যাবের অভিযানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিডনি কেনা-বেচা চক্রের অন্যতম হোতা ও ফেসবুক পেজের অ্যাডমিনসহ চক্রের পাঁচ সদস্যকে আইনের আওতায় আনা হয়। একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেন্দ্রিক কিডনি কেনা-বেচার অন্য চক্রগুলোকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে সাইবার মনিটরিং ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায় র্যাব। এরই ধারাবাহিকতায় গত মঙ্গলবার রাত ৮টা হতে গতকাল ভোর ৫টা পর্যন্ত র্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১ এর যৌথ অভিযানে রাজধানীর ভাটারা, বনশ্রী ও মিরপুর এলাকায় কিডনি ক্রয়-বিক্রয় সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা মো. শহিদুল ইসলাম মিঠু (৪৯), মো. মিজানুর রহমান (৪৪), মো. আল মামুন ওরফে মেহেদী (২৭), মো. সাইমন (২৮) ও মো. রাসেল হোসেন (২৪)কে গ্রেপ্তার করা হয়।
র্যাবের এই অধিনায়ক বলেন, অভিযানে কিডনি ক্রয়-বিক্রয় চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে বিভিন্ন ভিকটিমের সঙ্গে চুক্তির এফিডেভিট কপি, ভুক্তভোগীদের পাসপোর্টসহ মোট ১৪টি পাসপোর্ট, কিডনি ক্রস ম্যাচিংয়ের বিভিন্ন দলিলাদি, দেশি ও বিদেশি মুদ্রা, বিভিন্ন ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্র ও ফটোকপি, বিভিন্ন ব্যাংকের চেকবই ও এটিএম কার্ড, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের জাল সিলমোহর, খালি স্ট্যাম্প, সিপিইউ, মোবাইল ও সিম কার্ড জব্দ করা হয়।
গ্রেপ্তারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিডনি কেনা- বেচা এ চক্রের মোট সদস্য সংখ্যা ১৫ থেকে ২০ জন। তারা মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে কিডনি ক্রয়-বিক্রয়ের অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এ চক্রের সদস্যরা পার্শ্ববর্তী দেশে অবস্থানরত কিডনি কেনা-বেচা সদস্যদের চক্রের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রায় শতাধিক মানুষকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করেছে বলে জানা যায়।
তিনি বলেন, চক্রের প্রথম গ্রুপ ঢাকায় অবস্থান করে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রয়োজন’ এমন বিত্তশালী রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। চক্রের দ্বিতীয় দলটি প্রথম দলের চাহিদা অনুযায়ী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের গরিব ও অভাবী মানুষদের চিহ্নিত করে এবং তাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অর্থের বিনিময়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্য ডোনার হতে প্রলুব্ধ করে ঢাকায় নিয়ে আসে। পরবর্তীতে তৃতীয় অন্য একটি গ্রুপ প্রলোভনের শিকার ভুক্তভোগী কিডনি ডোনারদের ঢাকায় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রত্যাশী রোগীর সঙ্গে ব্লাড ম্যাচিং এবং অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করে। ব্লাড ম্যাচিং ও অন্যান্য ডায়াগনস্টিক টেস্টে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের উপযুক্ততা নিশ্চিত হলে তার পাসপোর্ট, ভিসা প্রসেসিং এবং ভুয়া কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে ভুক্তভোগী ডোনারকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করে। ওই চক্রের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশে অবস্থানকারী আরেকটি চক্র পারস্পরিক যোগসাজশে ভুক্তভোগী কিডনি ডোনারকে এয়ারপোর্ট অথবা স্থলবন্দরে রিসিভ করা থেকে শুরু করে হাসপাতালের ডকুমেন্টেশন, অস্ত্রোপচারসহ যাবতীয় কার্যক্রম শেষে ভিকটিমদের বৈধ/অবৈধ উপায়ে বিমান বা উত্তর পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত এলাকা দিয়ে দেশে ফেরত পাঠায়।
র্যাবের এ অধিনায়ক বলেন, গ্রেপ্তারকৃতরা এ চক্রের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ অবৈধ উপায়ে হাতিয়ে নিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করে। প্রতিটি কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য তারা রোগী প্রতি ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা গ্রহণ করতো। বিপরীতে তারা কিডনি ডোনারকে মাত্র চার থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা দেয়া হবে বলে আশ্বস্ত করে এবং অগ্রিম দুই লাখ টাকা প্রদান করতো। কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের পর প্রলোভনের শিকার কিডনিদাতাদের প্রতিশ্রুত অর্থ না দিয়ে নানাবিধ ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হতো।
বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, চক্রের মূল হোতা ও অন্যতম অভিযুক্ত মো. শহিদুল ইসলাম মিঠু ২০১৬ সালে নিজের চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। সেখানে অবস্থানকালীন তিনি কিডনি প্রতিস্থাপনের রোগীদের ব্যাপক চাহিদা দেখতে পান এবং নিজেই কিডনি প্রতিস্থাপনের অবৈধ ব্যবসা পরিচালনা শুরু করেন। পার্শ্ববর্তী দেশে অবস্থানরত কিডনি ক্রয়-বিক্রয় চক্রের সঙ্গে যোগসাজশে তিনি সেখানে একটি দালাল চক্র প্রতিষ্ঠা করেন এবং অনলাইনের মাধ্যমে আগ্রহী বিত্তশালী কিডনি রোগী এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে কিডনি ডোনার সংগ্রহসহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করতেন। এখন পর্যন্ত তার মাধ্যমে ৫০-এর অধিক কিডনি ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে মর্মে তিনি প্রাথমিকভাবে স্বীকার করেছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন