১৪৪৪। একটি নতুন হিজরি বর্ষের সূচনা। হিজরী বর্ষের প্রথম মাস মুহাররম, যা আশহুরে হুরুম তথা সম্মানিত চার মাসের একটি। যে চার মাসের কথা কোরআন মাজিদে এভাবে এসেছে : নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনায় মাস ১২টি, তন্মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস। এই প্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না...। (সূরা তাওবা : ৩৬)।
সুতরাং ‘তোমরা নিজেদের ওপর জুলুম করো না’ এই আসমানী নির্দেশনার সাথেই আমাদের হিজরি বর্ষের সূচনা হচ্ছে। ‘নিজের ওপর জুলুম’ কীভাবে হয়? ‘নিজের ওপর জুলুম’ হয় পাপাচারের দ্বারা, অনাচারের দ্বারা এবং অন্যায় অবিচারের দ্বারা। মানুষে কেন নিজের ওপর জুলুম করে? মানুষ নিজের ওপর জুলুম করে পরিণাম থেকে গাফেল হয়ে। কেউ যখন মনে করে তার কোনো জবাবদিহিতা নেই তখন সে বেপরোয়া হয়ে অন্যায়-অনাচারে লিপ্ত হয় এবং নিজের চরম ক্ষতিসাধন করে। একারণে আখিরাতে অবিশ্বাস বা আখিরাত সম্পর্কে উদাসীনতা মানুষের সকল অপকর্মের মূল। আর যারা মানুষকে আখিরাত থেকে বিমুখ বা উদাসীন করে তারাই মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু।
মানুষ মনে করে, অন্যকে কষ্ট দিয়ে, অন্যের সম্পদ লুণ্ঠন করে এবং অন্যের সম্মান বিনষ্ট করে নিজে লাভবান হবে। মানুষ তো সকল কাজ নিজের লাভের জন্যই করে; কিন্তু পরিণাম ও পরিণাম-দিবস সম্পর্কে উদাসীন থাকার কারণে সে উপলব্ধি করে না, সে আসলে নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করল। যখন অপ্রত্যাশিতভাবে তার কর্মের ফিরিস্তি-আমলনামা তার সামনে তুলে ধরা হবে, তখন সে চমকে ওঠবে এবং বলবে, এ কী অদ্ভুত কিতাব! এ তো ছোট বড় কোনো কিছুই বাদ দেয় না। সব সংরক্ষণ করে ফেলেছে।
শুধু আখেরাতেই নয়, দুনিয়াতেও মানুষকে তার অপকর্মের কিছু কুফল ভুগতে হয়। বিশেষত জুলুম-অত্যাচার, অন্যকে কষ্ট দেওয়া ও অন্যের হক্ব নষ্ট করার মতো বিষয়গুলো মানুষকে দুনিয়াতেও আলস্নাহর শাস্তির মুখোমুখী করে।
এক মানুষ অন্য মানুষের প্রতি বিভিন্নভাবে জুলুম করে। কখনো দৈহিকভাবে, কখনো মানসিকভাবে। কখনো সরাসরি অপমানের দ্বারা, কখনো মিথ্যাচারের দ্বারা। কখনো দোষ অন্বেষণের দ্বারা, কখনো অপবাদ আরোপের দ্বারা। কিন্তু এ সকল কিছুর কুফল অবশেষে অত্যাচারীর নিজেকেই ভুগতে হয়। হিজরি নতুন বছর সকলকে পরিণাম-সচেতনতার বার্তা প্রদান করে।
মানুষ স্বভাবগতভাবেই গৌরবপ্রবণ। মানুষ শক্তির গর্ব করে। সম্পদের গর্ব করে। আর সবচেয়ে বেশি জ্ঞান-বুদ্ধির গর্ব করে। আত্মগর্বী মানুষ জোরগলায় বলে ‘আমি ন্যায়ের পথে চলি। অন্যায়ের সাথে কখনো আপোষ করি না। আর আমি কারো অন্ধ অনুসারী নই ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবতা এই যে, মানুষ অন্যায়ে লিপ্ত হয়, ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে আর অনেক ক্ষেত্রেই তা হয় ভুল ব্যক্তির অনুসরণ বা ভুলের অনুকরণের কারণে। মানুষ যদিও বুদ্ধি ও স্বাতন্ত্রের বড়াই করে আসলে সে অনুকরণপ্রিয়। এমনকি যখন সে অনুকরণ বর্জনের ঘোষণা দেয় তখনও তা হয় কারো না কারো অনুকরণমাত্র।
অনুকরণমাত্রই দোষের নয়। সত্য-ন্যায়ের অনুকরণ সত্য ও ন্যায়ের মতোই বরণীয়। আর অন্যায় অসত্যের অনুকরণ অসত্য ও অন্যায়ের মতোই বর্জনীয়। কোরআন মাজিদে কী সুন্দরভাবেই না এ সত্য উল্লেখিত হয়েছে : জালিম ব্যক্তি সেদিন নিজের হস্তদ্বয় দংশন করতে করতে বলবে, ‘হায়! আমি যদি রাসূলের সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম! হায় দুর্ভোগ আমার; আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম! আমাকে তো সে বিভ্রান্ত করেছিল আমার কাছে উপদেশ পৌঁছার পর। শয়তান তো মানুষের জন্য মহাপ্রতারক। (সূরা ফুরকান : ২৭-২৯)।
তো রাসূলের পথ অনুসরণ ও হেদায়েতপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণের অনুকরণ শুধু কাম্যই নয়, মুক্তির অপরিহার্য শর্ত। আর গোমরাহীর পথের অনুসরণও গোমরাহ লোকদের অনুকরণ শুধু বর্জনীয়ই নয় চূড়ান্ত ক্ষতি ও আক্ষেপের কারণ। অধিকাংশ মানুষ মন্দ লোকের অনুসরণেই ভুল পথে যেয়ে নিজের ওপর জুলুম করে। সুতরাং দুনিয়া-আখেরাতে আত্মরক্ষার প্রধান উপায় মন্দ লোকের সংশ্রব বর্জন আর ভালো মানুষের সাহচর্য গ্রহণ। ভালোর সাহচর্য মানুষের ভালো হতে সাহায্য করে। হিজরী নতুন বর্ষ বলে, আমরা যেন ভালো মানুষের সাথে থাকি আর খারাপ মানুষের সাহচর্য ত্যাগ করি।
মানুষ সর্বাবস্থায় আল্লাহর ফয়সালার অধীন। তাঁর জীবন-মৃত্যু, সফলতা-ব্যর্থতা, সুপথপ্রাপ্তি ও বিপথগামিতা সব কিছুতেই তার মহাপরাক্রমশালী প্রভুর ফয়সালা কার্যকর। তাঁর আদেশে মানবের জীবন, তাঁর আদেশেই মৃত্যু। তাঁর আদেশেই মানবের সফলতা, তাঁর আদেশেই ব্যর্থতা। সুতরাং সেই মহাপ্রভু আল্লাহর কাছে করজোর প্রার্থনাই বান্দার সফলতা ও সুপথ প্রাপ্তির উপায়। আমাদের মহান রবের এক গুণ তিনি পরম করুণাময়। দুহাত তুলে তাঁর দরবারে যে চায় তিনি কখনো তাকে খালিহাতে ফিরিয়ে দেন না। সুতরাং যে তাঁর অভিমুখী হয় সে সৌভাগ্য লাভ করে আর যে তাঁর থেকে বিমুখ হয় সে তো আপন সৌভাগ্য থেকেই বিমুখ হয়।
হিজরি নতুন বর্ষ আমাদেরকে জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহমুখিতার আহবান জানায়। আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদের কবুল করুন- আমীন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন