পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল এক প্রতিভার নাম শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি রাজনীতিকে নিয়ে এসেছিলেন শিল্পের পর্যায়ে। তাই নিউজ উইকে বঙ্গবন্ধুকে আখ্যা দেওয়া হয়, পয়েট অফ পলিটিভ অর্থাৎ রাজনীতির কবি বলে। মহান এই রাজনীতিবিদ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য গান, অগণিত কবিতা। আজও লেখা হচ্ছে দেদারসে, ভবিষ্যতেও লেখা হবে। কবি অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর ছড়ায় যথার্থই বলেছেন -
যত দিন রবে পদ্মা মেঘনা/গৌরী যমুনা বহমান তত দিন রবে কীর্তি তোমার/শেখ মুজিবুর রহমান।
দিকে দিকে আজ অশ্রæগঙ্গা/রক্তগঙ্গা বহমান
নাই নাই ভয় হবে হবে জয়/জয় মুজিবুর রহমান। অন্নদাশঙ্কর রায়ের এই ছড়াটির পংক্তি বিভিন্নভাবে বিভিন্ন জায়গায় এতো বেশি ব্যবহার হয়েছে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম কবিতা লিখেন । ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার পর মর্মাহত কবি লিখলেন --
“ নরহত্যা মহাপাপ, তার চেয়ে পাপ আরো বড়ো/করে যদি তাঁর পুত্রসম বিশ্বাসভাজন/জাতির জনক যিনি অতর্কিতে তাঁরেই নিধন।/নিধন সবংশে হলে সেই পাপ আরো গুরুতর।
সারাদেশ ভাগী হয় পিতৃঘাতী সে ঘোর পাপের/যদি দেয় সাধুবাদ, যদি করে অপরাধ ক্ষমা।/কর্মফল দিনে দিনে বর্ষে বর্ষে হয় এর জমা/একদা বর্ষণ বজ্ররূপে সে অভিশাপের।
রক্ত ডেকে আনে রক্ত, হানাহানি হয়ে যায় রীত।/পাশবিক শক্তি দিয়ে রোধ করা মিথ্যা মরীচিকা।/পাপ দিয়ে শুরু যার নিজেই সে নিত্য বিভীষিকা।ছিন্নমস্তা দেবী যেন পান করে আপন শোণিত।/বাংলাদেশ! বাংলাদেশ! থেকো নাকো নীরব দর্শক ধিক্কারে মুখর হও। হাত ধুয়ে এড়াও নরক।
কবি অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর কবিতায় সারা দেশকে পাপী বলেছেন, যদি হত্যাকারীদের সাধুবাদ দেওয়া হয় কিংবা ক্ষমা করে দেওয়া হয়। আমরা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার করে সে পাপমোচন করেছি।
জাতির জনককে নিয়ে চমৎকার একটি কবিতা লিখেন কবি মহাদেব সাহা। তিনি তাঁর শেখ মুজিব আমার নতুন কবিতা শিরোনামের কবিতাটিতে লিখেন --
“ আমি আমার সমস্ত কবিত্ব শক্তি উজাড় করে/যে-কবিতা লিখেছি তার নাম শেখ মুজিব,/এই মুহূর্তে আর কোনো নতুন কবিতা লিখতে পারবো না আমি/কিন্তু এই যে প্রতিদিন বাংলার প্রকৃতিতে ফুটছে নতুন ফুল/শাপলা-পদ্ম-গোলাপ সেই গোলাপের বুক জুড়ে/ফুটে আছে মুজিবের মুখ/এদেশের প্রতিটি পাখির গানে মুজিবের প্রিয় নাম শুনি,/মনে হয় এরা সকলেই আমার চেয়ে আরো বড়ো কবি।/শেখ মুজিবের নামে প্রতিদিন লেখে তারা নতুন কবিতা ”/কবি মহাদেব সাহা বাংলাদেশের প্রকৃতির সর্বত্র শেখ মুজিবের মুখচ্ছবি দেখতে পান, বাংলাদেশের প্রতিটি পাখির কণ্ঠে শুনতে পান শেখ মুজিবের নাম। তাই তিনি এদেরকেই বড়ো কবি বলে মনে করেন।
কবি রফিক আজাদ তাঁর এই সিঁড়ি কবিতায় অসামান্য পংক্তিমালা উপস্থাপন করেছেন --
এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে,/সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে/বত্রিশ নম্বর থেকে/সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে/অমল রক্তের ধারা বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে।/মাঠময় শস্য তিনি ভালোবাসতেন,/আয়ত দু’চোখ ছিল পাখির পিয়াসী,/পাখি তাঁর খুব প্রিয় ছিল/গাছ-গাছালির দিকে প্রিয় তামাকের গন্ধ ভুলে
চোখ তুলে একটুখানি তাকিয়ে নিতেন,/পাখিদের শব্দে তাঁর, খুব ভোরে, ঘুম ভেঙে যেত।/স্বপ্ন তাঁর বুক ভরে ছিল,/পিতার হৃদয় ছিল, স্নেহের-আর্দ্র চোখ/এ দেশের যা-কিছু তা হোক না নগণ্য, ক্ষুদ্র তাঁর চোখে মূল্যবান ছিল/নিজের জীবনই শুধু তাঁর কাছে খুব তুচ্ছ ছিল;/স্বদেশের মানচিত্র জুড়ে পড়ে আছে/বিশাল শরীর তাঁর রক্তে এই মাটি উর্বর হয়েছে/সবচেয়ে রূপবান দীর্ঘাঙ্গ পুরুষ/তাঁর ছায়া দীর্ঘ হতে হতে/মানচিত্র ঢেকে দ্যায় সস্নেহে আদরে/তাঁর রক্তে প্রিয় মাটি উর্বর হয়েছে/তাঁর রক্তে সবকিছু সবুজ হয়েছে।/এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে,/সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে /স্বপ্নের স্বদেশ ব্যেপে/সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে/অমল রক্তের ধারা বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে।/কবি রফিক আজাদ বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর রক্ত বত্রিশ নম্বরের সিঁড়ি বেয়ে পুরো বাংলাদেশকে ভিজিয়ে দিয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। এদেশের মাটিকে উর্বরতা দান করেছে শেখ মুজিবের রক্ত।
কবি সৈয়দ শামসুল হক তাঁর পনেরো আগস্ট কবিতাটিতে অসামান্য দ্যোতনায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখেন --
এখনও রক্তের রঙ ভোরের আকাশে।/পৃথিবীও বিশাল পাখায় গাঢ় রক্ত মেখে/কবে থেকে ভাসছে বাতাসে। (অসমাপ্ত)
/অপেক্ষায়- শব্দের- শব্দেই হবে সে মুখর- আরো একবার/জয় বাংলা ধ্বনি লয়ে যখন সূর্যের আলো তার/পাখায় পড়বে এসে/ইতিহাস থেকে আরো কিছুক্ষণ পরে।/মানুষ তো ভয় পায় বাকহীন মৃত্যুকেই,/তাই ওঠে নড়ে/থেকে থেকে গাছের সবুজ ডাল পাতার ভেতরে।/পাতাগুলো হাওয়া পায়,/শব্দ করে ওঠে আর খাতার পাতাও/ধরে ওঠে অস্থিরতা- কখন সে পাবে স্বর-
জয় বাংলা ঝড়- তাকে দাও/জন্মনাভি! বোঁটা থেকে দ্যাখো আজও/অভিভূত রক্ত যায় ঝরে/বাঙালির কলমের নিবের ভেতরে।/স্তব্ধ নয় ইতিহাস! বাংলাও সুদূরগামী/তেরোশত নদীর ওপরে ওই আজও তো নৌকোয়/রক্তমাখা জনকের উত্থান বিস্ময়!
কবি সৈয়দ শামসুল হক বলেন, ইতিহাস স্তব্ধ নয়। বাংলাও থেমে নেই, বাংলা সুদূরগামী। জয় বাংলা ¯েøাগানে মুখরিত হবে এ দেশ। কেননা, এদেশের তেরোশত নদীর নৌকার পালে বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত উত্থান তিনি দেখতে পেয়েছেন। সৈয়দ শামসুল হকের আশাবাদ ব্যর্থ হয়নি। জয় বাংলা আজ জাতীয় ¯েøাগান, বঙ্গবন্ধু আজ সারা বিশ্বের বিস্ময়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন