এই ধুলার ধরণীতে বাবা আদম (আ.) ও মা হাওয়া (আ.)-এর প্রবর্তণের পর পর্যায়ক্রমে গড়ে উঠেছে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতীয় জীবনের ক্রমবর্ধমান স্রোতধারা। তাই তো পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গিরি কন্দর ও শৈল শিখর হতে শুরু করে অতল-অতলান্ত সমুদ্র ও মহা সমুদ্রের বুকে জেগে ওঠা দ্বীপ-দ্বীপান্তরের সর্বত্রই মানুষের কল-গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। আল্লাহ পাকের সাজানো বাগানে মানুষ গড়ে তুলেছে কৃষ্টি, সভ্যতা, উন্নতি ও অগ্রগতির সুনিপুণ পশরা। ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে মানুষ। শুধু কেবল এই ভূমণ্ডলেই নয়, বরং ভূলোক দ্যোলোক ও গোলক ভেদ করে মহাকাশেও মানুষ পাড়ি জমাচ্ছে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহী কবিতায় দৃপ্ত কণ্ঠে গেয়েছেন : ‘বল, মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি/চন্দ্র, সূর্য, গ্রহতারা ছাড়ি/ ভূলোক, দ্যোলোক, গোলক ছেদিয়া/খোদার আসন আরশ ভেদিয়া/উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর/চির উন্নত মমশির’।
তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বেঈমান ও নাফরমান উন্নত শিরের অধিকারী বহু মানুষকে আল্লাহপাক টুঁটি টিপে ধরে ধ্বংসের অতল সাগরে বিলীন করে দিয়েছেন। কালের খাতায় ইতিহাসের পাতায় তাদের স্মৃতি চিহ্নটুকুই কেবল দেখা যায়। আর বাকি সব বিস্মরণের খেয়াঘাটে হারিয়ে গেছে। আল কুরআনে এতদসংক্রান্ত বিবরণ এভাবে স্থান লাভ করেছে। যথাÑ ইরশাদ হয়েছে : তবে কি সে জানে না যে, আল্লাহ তার পূর্বে অনেক সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছেন, যারা শক্তিতে তার চাইতে প্রবল এবং ধনসম্পদে অধিক প্রাচুর্যশীল ছিল। (সূরা আল কাসাস : ৭৮)।
এই আয়াতে কারীমার শানে নুযুল হতে জানা যায় যে, ধনকুবের কারূন তার অহঙ্কার, অহমিকা ও প্রচণ্ড দাপটের সাথে মানুষের ওপর জুলুম-নির্যাতনের স্টিমরোলার চালাতে শুরু করলে তার সম্প্রদায় তাকে বলল, দম্ভ করো না, আল্লাহ দাম্ভিকদের ভালোবাসেন না। আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন, তদ্বারা পরকালের গৃহ অনুসন্ধান করো এবং ইহকাল থেকে তোমার অংশ ভুলে যেয়ো না। তুমি অনুগ্রহ করো, যেমন আল্লাহ তোমার ওপর অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অনর্থ সৃষ্টিকারীকে পছন্দ করেন না।
উত্তরে কারূন বললেন : আমি এই ধন সম্পদ আমার নিজস্ব জ্ঞান ও মেধার দ্বারা অর্জন করেছি। তাতে আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহের কোনো দখল নেই। এটা আমি আমার বিচক্ষণতা ও কর্মতৎপরতার দ্বারা অর্জন করেছি। তার এই ঔদ্ধত্যের কারণে আল্লাহপাক তাকে এবং তার সমুদয় ধনসম্পদ ধ্বংস করে দিয়েছেন।
ঠিক একইভাবে চলমান বিশ্বের কারূন সদৃশরাও ভাবছে যে, আবিষ্কার, বিজ্ঞানের ধ্বংসাত্মক উন্নতি, কর্মতৎপরতা, বিচক্ষণতা, পরিশ্রম, শিল্প অথবা ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি ও উৎকর্ষ আমাদের নিজস্ব জ্ঞান-গরিমার বাহারী ফসল। আমাদের মিটিয়ে দেয়া সহজ কাজ নয়! তারা বেমালুম ভুলে গেছে যে, তাদের কর্মতৎপরতা ও কারিগরি জ্ঞান দ্বারা যা কিছু অর্জিত হয়েছে তা আল্লাহ পাকের অনুগ্রহ হতে মুক্ত হতে পারে না।
কেননা, এই কারিগরি জ্ঞান এবং উপার্জন শক্তি তো আল্লাহ তায়ালারই দান। তাছাড়া আল্লাহর সৃষ্টি মৌলিক উপাদানসমূহ ব্যবহার করেই তো তাদের সফলতা অর্জিত হয়েছে। সুতরাং আল্লাহ পাকের এতসব অনুগ্রহ ও অনুদানের প্রতি যারা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে চলে, তারা অতীতেও যেমন আজাব, গজব ও ধ্বংসের হাত হতে রেহাই পায়নি, এই শ্রেণির লোকেরা বর্তমানেও রেহাই পাবে না। এবং ভবিষ্যতেও তাদের জন্য মুক্তি ও নিষ্কৃতির পথ খোলা নেই। এহেন না থাকার অপর একটি কারণ হলো এই যে, কারূনপন্থীরা দুনিয়ার ভোগ সম্ভারের প্রতি আসক্ত থাকাকে একমাত্র লক্ষ্যস্থির করে চলে। পরকালের চিরস্থায়ী সুখের প্রতি তাদের দৃষ্টি কখনো নিবদ্ধ হয় না। ফলে তারা যখন অবাধ্যতার পথে চলতে থাকে, তখন আল্লাহর আজাব তাদের হঠাৎ পাকরাও করে। তখন অগাধ ধন সম্পদ, শক্তি সামর্থ্য, ঐশ্বর্য, ঐতিহ্য কোনো কাজে আসে না।
ইরশাদ হয়েছে : এতে কি তাদের চোখ খোলেনি যে, আমি তাদের পূর্বে অনেক সম্প্রদায়কে ধ্বংস করেছি, যাদের বাড়ি-ঘরে তারা বিচরণ করে। অবশ্যই এতে নিদর্শনাবলি রয়েছে। তারা কি শোনে না? (সূরা সেজদাহ : ২৬)।
এই আয়াতে কারীমায় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, অতীতে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি গোষ্ঠীর স্মৃতিচিহ্ন এবং বিরান বাড়ি-ঘরে প্রায়শই লোকেরা চলাফেরা করে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে তথায় গমনা-গমন করে। তবে কি তারা এ সকল নিদর্শনাবলি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে না? তারা কি এ সমস্ত স্থানে বসবাসকারীদের করুণ পরিণতি দেখতে পায় না?
মোদ্দাকথা হচ্ছে এই যে, দেখা, বোঝা এবং উপলব্ধি করার মতো অন্তর তাদের মধ্যে নেই বিধায় আল্লাহ দ্রোহিতার ওপরই তারা অবিচল ছিল। ফলে, আল্লাহপাক তাদের ধ্বংস করে দিয়েছেন। অতএব অনাগতকালেও যারা আল্লাহ ও রাসূলের বিরোধিতায় জমে থাকবে, তাদেরও ধ্বংস অনিবার্য। যত বড় শক্তিধরই হোক না কেন, তাদের নিস্তার মিলবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন