মানুষের জীবনে এমন কিছু অনুসঙ্গ আছে, যার পরশ হতে দূরে থাকা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। তন্মধ্যে আক্ষেপ, অনুতাপ ও অনুশোচনা একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। তবে, এমন কিছু মানুষ ও পৃথিবীতে আছে, যারা চিরস্থায়ী অনুতাপের পথ বেছে নেয়। তাদের মধ্যে কাফের ও অবিশ্বাসীদের স্থান সবার ঊর্ধ্বে। এতদ প্রসঙ্গে আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : নিঃসন্দেহে যেসব লোক কাফের, তারা নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে যাতে করে আল্লাহর পথে বাঁধাদান করতে পারে। বস্তুত : এখন তারা আরও ব্যয় করবে। তারপর তাই তাদের জন্য আক্ষেপের কারণ হবে এবং শেষ পর্যন্ত তারা হেরে যাবে। আর যারা কাফের, তাদেরকে দোজখের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। (সূরা আল আনফাল : ৩৬)।
এই আয়াতে কারীমার অর্থ ও মর্মের প্রতি গভীর দৃষ্টিতে তাকালে যে সকল বিষয়ের স্পষ্ট জ্ঞান লাভ করা যায়, তা এই। যথা : (ক) কাফেররা তাদের সম্পদের বৃহদংশ আল্লাহর পথে বাঁধা দেয়ার কাজে ব্যয় করে। এর উদাহরণ হলো বদর ও ওহুদ যুদ্ধে তাদের পরাজয়। বদর যুদ্ধে কাফেরদের সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা ছিল এক হাজার। অপর পক্ষে মুসলমানদের সৈন্য বাহিনীর সংখ্যা ছিল ৩১৩ জন।
কাফেরদের বাহিনীর খাবার-দাবার এবং অন্যান্য যাবতীয় ব্যয়ভার তৎকালিন মক্কার বার জন সর্দার নিজেদের দায়িত্বে নিয়ে নিয়েছিল। তাদের মধ্যে ছিল সেনাপতি আবু জাহল, ওতবা শায়বা প্রমুখ ধনাঢ্য ব্যক্তিরা। এই যুদ্ধে এক হাজার সৈন্যের যাতায়াত ও খানাপিনা বাবত বিরাট অঙ্কের অর্থ ব্যয় হয়েছিল। এই যুদ্ধে চূড়ান্ত পরাজয়ের সাথে সাথে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচের জন্য ও তাদেরকে অনুতাপ ও আফসোসের তীব্র দহন জ্বালায় জর্জরিত হতে হয়েছিল।
তারপর মক্কার কাফেররা বদর যুদ্ধের প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে এবং এক বছরের মাথায় ওহুদ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। বিপুল সৈন্য সংখ্যা ও অজস্র অর্থ ব্যয় করেও তারা শেষ পর্যন্ত পরাজিত ও পলায়ন করতে বাধ্য হয়। বিজয় অর্জিত না হওয়া এবং পলায়নের গ্লানীর সাথে সাথে অর্থ-সম্পদ ব্যয়ের অতিরিক্ত অনুতাপ ও দুঃখ তাদেরকে পোহাতে হয়েছে।
(খ) বর্তমান কালের কাফেররাও পূর্ববর্তীদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আল্লাহর পথে বাঁধা দেয়ার কাজে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকায় এবং পৃথিবীর অন্যান্য অংশে বসবাসকারী মুসলমানদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করলে তা অতি সহজেই উপলব্ধি করা যায়। তারা মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে এবং নিজেদের মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও বাতিল মতোবাদের প্রতি আহ্বান জানাতে গিয়ে লাখ লাখ টাকা হাসপাতালে, শিক্ষাঙ্গনে ও দান-খয়রাতের নামে ব্যয় করে থাকে।
তাদের দলভুক্ত ওই সকল পথভ্রষ্ট ব্যক্তিরা ও যারা ইসলামের সত্য ও সর্ববাদিসম্মত আকীদা বিশ্বাসসমূহে সন্দেহ, অবিশ্বাস, সংশয় ও দ্বন্দ্ব সৃষ্টির কাজে ব্যাপৃত রয়েছে এবং এর জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে কুণ্ঠাবোধ করছে না। কিন্তু মহান আল্লাহ পাক দ্বীনের হেফাজত করে চলেছেন বলেই বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ ব্যয় করা সত্ত্বেও কাফেররা নিজেদের উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ ও অকৃতকার্য থেকে যায়। ফলে, অনুতাপ ও মর্ম যাতনার তীব্র দহনে অহরহই তাদের বিদগ্ধ হতে হচ্ছে।
(গ) অতঃপর এমন একটা সময় আসবে, যখন তারা চূড়ান্ত পরাজয়ের সম্মুখীন হবে। বিদ্যা-বুদ্ধি, ধনবল, অস্ত্রবল ও অর্জিত ধন-সম্পদ তাদের কোনো উপকারে লাগবে না। ধ্বংস ও পরাজয়ের সুকঠিন তাণ্ডবলীলার অথই সাগরে চিরতরে তলিয়ে যাবে। তাদের নাম-নিশানা, শৌর্য-বীর্যের কোনো চিহ্নই পৃথিবীতে অবশিষ্ট থাকবে না। এই বিশেষত্বাটিই পরম বিজ্ঞানময় আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত উপরোক্ত আয়াতে কারীমার ‘ইউগ্লাবুন’ শব্দের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন এবং তাদের ব্যাপারে তিনি যে সর্ব বিষয়ে সুপরিজ্ঞাত তার ঘোষণা প্রদান করেছেন।
আমরা দেখতে পাই, চুম্বক লোহাকে আকর্ষণ করে। ঠিক একইভাবে মানুষের কাজকর্ম আচার-আচরণ এবং স্বভাব চরিত্রের মধ্যে ও একটা আকর্ষণের ছাপ লক্ষ্য করা যায়। একটি ভালো কাজ অন্যান্য ভালো কাজকে আকর্ষণ করে। একইভাবে একটি মন্দ কাজ আর একটি মন্দ কাজকে আকর্ষণ করে। একটি হারাম ও খারাপ সম্পদ আর একটি খারাপ ও মন্দ সম্পদকে টেনে আনে।
তারপর এ সকল খারাপ সম্পদ মিলে দুনিয়া জোড়া খারাপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বর্তমান দুনিয়ায় খারাপ সম্পদের অধিকারীরাই তো’ নাটের গুরু হয়ে কলকাঠি নাড়ছে। তাদের কর্মকাণ্ডের প্রতিকার ও প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাকের পাকরাও হতে তারা রেহাই পাবে না। তাই তো উল্লিখিত আয়াতে কারীমার শেষাংশে মহান আল্লাহপাক সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন : ‘আর যারা কাফের, তাদেরকে দোজখের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।’ আর এটাই হবে চিরস্থায়ী আক্ষেপ, অনুতাপ ও অনুশোচনায় বিদগ্ধ হওয়ার উত্তম নিবাস। মহান আল্লাহপাক এহেন জ্বলন্ত নিবাস হতে আমাদের বিমুক্ত রাখুনÑ আমীন!
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন