বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম

কোরআন মজীদে মোহর বিধান ও শিক্ষা-১

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ২৯ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

ইসলামের যে বিধানগুলো স্বয়ং আল্লাহতায়ালা বারবার বিভিন্ন আয়াতে বয়ান করেছেন তার অপরিহার্যতা বলার অপেক্ষা রাখে না। মানুষের অবহেলা ও অমনোযোগিতার কারণে সেসব বিধান সমাজের চোখে গুরুত্বহীন হয়ে গেলেও আল্লাহর কাছে তা গুরুত্বহীন নয়।

ঐসব বিধানের অন্যতম হচ্ছে নারীর মোহর। কত প্রসঙ্গে কতভাবে যে আহকামুল হাকিমীন আল্লাহ এ বিধানটি বয়ান করেছেন! বিবাহবন্ধনের প্রসঙ্গে, বিবাহ-বিচ্ছেদের প্রসেঙ্গ, ঈমানদার ব্যক্তি ও সমাজের বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে, জাহেলী-সমাজের বর্বরতা রোধ প্রসঙ্গে মোটকথা অনেকভাবে অনেক জায়গায় মোহরের বিধান বর্ণনা করেছেন। তাই কোরআন মজীদে যেমন আছে এর আইন ও বিধানগত দিক তেমনি আছে, নৈতিক ও মানবিক দিক, যা মুমিনের চিন্তা ও মস্তিষ্কের পাশাপাশি আলোড়িত করে তার কলব ও হৃদয়কেও। এই সকল কিছুর সাথে মুমিন নর-নারীকে স্মরণ করানো হয়েছে আল্লাহর আদালত ও বিচার-দিবসের অমোঘ সত্যের কথা। তাই একমাত্র কোরআনই পারে নারী-পুরুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে এবং সঠিক পথের দিশা দিতে যদি তারা সমর্পিত হয় কোরআনের বিধান ও শিক্ষার প্রতি।

বিয়েতে মোহর অপরিহার্য। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন : উল্লিখিত নারীরা ছাড়া অন্যদের তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে, যে স্বীয় সম্পদ দ্বারা প্রয়াসী হবে তাদের সাথে বিবাহবন্ধনে, ব্যভিচারে নয়। অতএব তাদের নিকট থেকে তোমরা যে আনন্দ উপভোগ করেছ (সে কারণে) তাদের ধার্যকৃত মোহর তাদের প্রদান করবে। আর মোহর নির্ধারিত থাকার পরও কোনো বিষয়ে পরস্পর সম্মত হলে তাতে তোমাদের কোনো অপরাধ হবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (সূরা নিসা : ২৪)।

এই আয়াতে বিয়ে-শাদি সম্পর্কে কিছু মৌলিক বিধান দেওয়া হয়েছে, যার বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে হাদীস শরীফে। এই আয়াত থেকে যে বিধানগুলো পাওয়া যায় তা হচ্ছে : ১. ‘মুহাররামাত’ (যাদের সাথে বিবাহ হারাম করা হয়েছে) ছাড়া অন্যদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ। কোরআন মজীদে ও হাদীস শরীফে মুহাররামাতের বিবরণ ও আনুষঙ্গিক বিধানাবলি দেওয়া হয়েছে।

২. মোহর ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ ফরয এবং বিয়ের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। মোহর ছাড়া বিয়ে হয় না। আকদের সময় উল্লেখ না করলেও কিংবা না দেওয়ার শর্ত করলেও মোহর বাতিল হয় না। ৩. স্বামীর কর্তব্য যথাযথভাবে মোহর পরিশোধ করা। ৪. বিয়ের পর সহবাস হলে (কিংবা একান্তে সাক্ষাৎ হলে, যাকে পরিভাষায় ‘খালওয়াতে সহীহা’ বলে), পূর্ণ মোহর আদায় করা অপরিহার্য। সুতরাং আকদের সময় মোহর ধার্য করা হলে ধার্যকৃত পূর্ণ মোহর আর ধার্য না হয়ে থাকলে মোহরে মিছ্ল দিতে হয়।

৫. ধার্যকৃত মোহর থেকে স্ত্রী যেমন কিছু ছেড়ে দিতে পারে তেমনি স্বামীও কিছু বেশি দিতে পারে। স্বেচ্ছায় স্বাগ্রহে হলে এতে কোনো দোষ নেই। ৬. মোহর এমন কিছু হতে হবে, যা শরীয়তের দৃষ্টিতে ‘মাল’ (সম্পদ) বলে গণ্য। মোহরের সর্বনিম্ন পরিমাণ কোরআন মজীদে স্পষ্টভাবে বলা হয়নি। হাদীস, আছার ও শরীয়তের অন্যান্য দলিলে তা বলা হয়েছে। ফিকহে হানাফী অনুসারে সর্বনিম্ন মোহর দশ দিরহাম। ৭. বিয়েতে ইজাব-কবুল ও সাক্ষী অপরিহার্য। এই শর্তগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যা হাদীস শরীফে রয়েছে। (আহকামুল কোরআন, জাসসাস ২/১৪০-১৪৬; তাফসীরে উছমানী পৃ. ১০৫)।

উপরোক্ত বিধানগুলো ছাড়াও একজন মুমিন এই আয়াত থেকে আরো কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন। যেমন : ১. মোহর যদিও একটি মধুর লেনদেন এবং ঐভাবেই তা আদায় করা উচিত, তবে তা নিছক উপহার নয় যে, ইচ্ছা হলে দেওয়া যায়, ইচ্ছে হলে বিরত থাকা যায়; বরং তা হল স্ত্রীর প্রাপ্য অধিকার। স্ত্রী যেমন প্রীতি ও ভালোবাসার সাথে নিজেকে অর্পণ করেছে, স্বামীরও কর্তব্য সম্মান ও মর্যাদার সাথে তার মোহর আদায় করা। ২. স্ত্রীর মোহর ফাঁকি দেয়া অতিহীন কাজ। কারণ এর অর্থ দাঁড়ায়, ভোগ করতে রাজি, কিন্তু বিনিময় দিতে রাজি নয়। যে স্বামীর মনে স্ত্রীর মোহর আদায়ের ইচ্ছাটুকুও নেই হাদীস শরীফে তাকে বলা হয়েছে ‘ব্যভিচারী’। (মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/৫২২-৫২৩)

৩. অনেক বড় অংকের মোহর ধার্য করা যেমন শরীয়তে কাম্য নয় তেমনি তা একেবারে তুচ্ছ ও সামান্য হওয়াও উচিত নয়। মোহরের পরিমাণ এমন হওয়া চাই, যা সাধারণত আগ্রহের বিষয় হয়। নবী (সা.) এর সুন্নাহ ও সাহাবায়ে কেরামের সাধারণ রীতি এক্ষেত্রে উত্তম আদর্শ। হাদীস শরিফে ইরশাদ হয়েছে : আবু সালামা ইবনে আবদুর রহমান বলেন, আমি (উম্মুল মুমিনীন) আয়েশা (রা.) কে জিজ্ঞাসা করলাম যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী পরিমাণ মোহর দিয়েছেন? তিনি বললেন, ‘নবী (সা.) তাঁর স্ত্রীদের সাড়ে ১২ উকিয়া অর্থাৎ ৫০০ দিরহাম মোহর দিয়েছেন।’ (সহীহ মুসলিম : ১৪২৬)।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (4)
শঙ্খনীল শাকিল ২৯ আগস্ট, ২০২২, ৭:৩২ এএম says : 0
দেনমোহর বিষয়ে সমাজে চরম অজ্ঞতা ও উদাসীনতা বিরাজমান। ধর্মকে ভালোবাসেন, নিয়মিত নামাজ-রোজা করেন; এমন অনেক মানুষও মোহরের বিষয়ে সচেতন নন। এ বিষয়ে উদাসীনতা এতটাই প্রকট যে, অনেকে নফল নামাজকে যতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন, মোহর আদায়কে তার সিকিভাগও মনে করেন না। অথচ তা একটি ফরজ বিধান ও বান্দার হক, যা আদায় করা ছাড়া মানুষ প্রকৃত দ্বীনদার হতে পারে না।
Total Reply(0)
Md Parves Hossain ২৯ আগস্ট, ২০২২, ৭:৩২ এএম says : 0
বর্তমানে দেনমোহর পরিশোধ না করা অনেকটা নিয়মে পরিণত হয়েছে। সাধারণ রেওয়াজ হলো, বিয়ের সময় মোটা অংকের মোহর ধার্য করা হয়, বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চায়, অপারগতার কারণে স্ত্রী মৌখিকভাবে মাফ করে দেয়। এভাবেই স্ত্রীর একটি আর্থিক প্রাপ্তি ও অধিকার হারিয়ে যায়।
Total Reply(0)
Md Ali Azgor ২৯ আগস্ট, ২০২২, ৭:৩২ এএম says : 0
কোরআনে কারিম ‘ন্যায়সংগত মোহর’ নির্ধারণ করতে বলেছে, তাই স্বামীর অর্থনৈতিক শক্তি-সামর্থ্য বিবেচনা করে যৌক্তিকভাবে মোহর নির্ধারণ করতে হবে। মোহর কোনো অর্থবিত্তের প্রতিযোগিতার বিষয় নয়, এটি স্বামীর ওপর ন্যস্ত অবধারিত কর্তব্য। এ কর্তব্য পালনে কোনো ধরনের দায়সারা মনোভাব পোষণের অবকাশ নেই।
Total Reply(0)
Antara Afrin ২৯ আগস্ট, ২০২২, ৭:৩২ এএম says : 0
মোহর আল্লাহর বিধান হলেও সেটি ধার্য করার কর্তব্য বর-কনে কিংবা তাদের অভিভাবকদের। আমাদের সমাজে সাধারণত উভয়পক্ষের মুরব্বিরা তা নির্ধারণ করেন। এ ক্ষেত্রে তারা বর-কনে উভয়ের নিকটাত্মীয় মা-বাবা-ভাইবোন ও ভাবী, খালা, ফুফুকে প্রদত্ত মোহরের সঙ্গে তুলনা করে সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় এটি নির্ধারণ করেন।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন