আধুনিক ও বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে ২০ বছর মেয়াদি ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান তথা ড্যাপের অনুমোদন দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। এ প্রজ্ঞাপন হওয়ার পর নতুন ভবন নির্মাণের আবেদন অনুমোদন নেয়ার হিড়িক পড়েছে রাজউকে। এলাকাভিত্তিক জনঘনত্ব এবং বেজ ফার ভবন নির্ধারণ করা, রাস্তা প্রশস্তকরণ এবং সকল নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি বিধান যুক্ত করে ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান-ড্যাপ চূড়ান্ত করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক)। নতুন ড্যাপের আগামী ২০৩৫ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। নতুন ড্যাপে তলাভিত্তিক ভবন নির্মাণের নিয়ম বাতিল করা হয়েছে।
এদিকে নতুন ড্যাপে ভবনের উচ্চতা নিয়ে যাদের সমস্যা রয়েছে। এটি কার্যকরে আগে যারা অনুমোদন নিয়েছেন, তারা চাইলে অনুমোদনপত্র ও নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মাণ করতে পারবেন। নতুন ড্যাপ কার্যকর হওয়ার আগে যারা ভবন নির্মাণ অনুমোদন নিয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে নতুন নিয়ে করতে হবে না। সংস্থা থেকে সাধারণত বছরে গড়ে চার হাজারের মতো ভবন নির্মাণের অনুমোদন হয়। কিন্তু নতুন ড্যাপ কার্যকরের আগে হঠাৎ আবেদনের সংখ্যা অনেক বেড়ে যায়। ফলে অনুমোদনের সংখ্যাও বেড়েছে। আবেদনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে নতুন ড্যাপ দ্রুত কার্যকর হতে যাচ্ছে। এমন চিন্তা ভবন মালিকদের মধ্যে কাজ করেছে বলে মনে করেন রাজউকের কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) প্রধান প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন) প্রকৌশলী উজ্জল মল্লিক ইনকিলাবকে বলেন, আধুনিক ও বাসযোগ্য নগর হিসেবে গড়ে তুলতে ২০ বছর মেয়াদি ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান তথা ড্যাপের অনুমোদন দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হওয়ার পর নতুন ভবন নির্মাণের আবেদন পড়া শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, নতুন ড্যাপে তলাভিত্তিক ভবনের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণের কৌশল বাতিল করা হয়েছে। তবে এলাকাভিত্তিক ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এগুলো দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়।
ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। সব এলাকায় তো একই ঘনত্বে মানুষ বসবাস করবে না। কারণ, সব এলাকার বৈশিষ্ট্য এক নয়। যদি ধানমন্ডি এলাকার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে রায়েরবাজারের বৈশিষ্ট্য মেলান, তাহলে তো হবে না। শহরের পরিবেশ ঠিক রেখে নতুন ভবন নির্মাণে আবেদন গ্রহণ করা হচ্ছে।
নতুন এ ড্যাপের খসড়া ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রকাশ করা হয়। খসড়ায় রাজউক এলাকায় জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণে আবাসিক ভবনের উচ্চতা সর্বোচ্চ আটতলা নির্ধারণ করা হয়। মূলত এর পর থেকেই ভবনের নির্মাণ অনুমোদনের আবেদন বেড়ে যায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগ ভবন মালিকই উঁচু আবাসিক ভবন বানাতে চান। নতুন ড্যাপ কার্যকর হলে তারা প্রত্যাশা অনুযায়ী উঁচু ভবন নির্মাণ করতে পারবেন না, এমন আশঙ্কা করেছিলেন ভবন মালিকেরা। তাই তারা দ্রুত ভবন নির্মাণ অনুমোদনের আবেদন করেছিলেন, যাতে নতুন ড্যাপ কার্যকর হওয়ার আগেই আশানুরূপ উচ্চতার ভবন নির্মাণ করা যায়।
রাজউক এলাকায় প্রতি বছর গড়ে চার হাজারের মতো ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়। রাজউকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে ৫ হাজার ৬১২টি ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল। করোনাকালে দেশে লকডাউনসহ নানা বিধিনিষেধ ছিল। তা সত্ত্বেও রাজউকে ভবন নির্মাণ অনুমোদনের আবেদন ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। ২০২১ সালে ১০ হাজার ৩২টি ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়, যার বেশির ভাগই ছিল আবাসিক ভবন। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত ৯ হাজার ৬৫৬টি ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে রাজউক। নতুন ড্যাপ কার্যকর হওয়ায় এখন আবার পরিস্থিতি আগের মতো হতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। নতুন ড্যাপের প্রজ্ঞাপন জারি হওযার পর গত ২০১০ সালে পাস হওয়া ড্যাপ রহিত করা হয়। তবে ২০১০ সালের ড্যাপের আলোকে যেসব কার্যক্রম হয়েছে, তা বৈধ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন ড্যাপে তলাভিত্তিক ভবন নির্মাণের নিয়ম বাতিল করা হয়েছে।
ভবন নির্মাণ অনুমোদনের জন্য কেউ ছাড়পত্রের আবেদন করলে শুরুতে ড্যাপ-সংশ্লিষ্ট জমির শ্রেণি যাচাই করে দেখা হয়। ফলে ড্যাপে কোনো এলাকায় বা প্লটে আবাসিক ভবনের সর্বোচ্চ উচ্চতা আটতলা ধরা হলে সেখানে বৈধভাবে আর তলা বাড়ানো সম্ভব ছিল না। নতুন ড্যাপে তলাভিত্তিক ভবনের উচ্চতা নিয়ন্ত্রণের কৌশল বাতিল করা হয়েছে। তবে এলাকাভিত্তিক ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) নির্ধারণ করা হয়েছে। মূলত এফএআরের মাধ্যমে একটি প্লটে কত আয়তন বা উচ্চতার ভবন নির্মাণ করা হবে, তা নির্ধারণ করা হয়। যেসব এলাকায় নাগরিক পরিষেবার মান ভালো, পার্ক বা উন্মুক্ত স্থান আছে, প্লটের পাশে প্রশস্ত রাস্তা আছে, সেসব এলাকায় এফএআরের মান বেশি ধরা হয়েছে। আর যেসব এলাকায় রাস্তা সরু ও নাগরিক সেবার মান তুলনামূলকভাবে খারাপ, সেসব এলাকায় এফএআরের মান কম ধরা হয়েছে। এলাকাভিত্তিক এফএআর ভিন্ন হওয়ায় প্লট ও পাশের রাস্তার আয়তন একই হওয়া সত্ত্বেও পুরান ঢাকা ও গুলশানে একই উচ্চতার ভবন এখন আর নির্মাণ করা যাবে না। আগে রাস্তা ও প্লটের আকার একই হলে দুই এলাকাতেই সমান আয়তন বা উচ্চতার ভবন নির্মাণের সুযোগ ছিল। নগর অঞ্চল পরিকল্পনা (১৯৯৫-২০০৫) প্রণয়ন করা হয়। ২০০৪ সালে ড্যাপের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। ২০১০ সালের ২২ জুন এটি গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। ড্যাপে ঢাকার মোট আয়তন ধরা হয় এক হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার বা ৫৯০ বর্গমাইল। রাজধানীতে এখন ভবন নির্মাণ করা হয় ২০১০ সালের ড্যাপ ও ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে। ১৯৯৬ সালের বিধিমালায় ধানমন্ডিতে যে জমিতে ৬ তলা ভবন নির্মাণ করা যেত, ২০০৮ সালের বিধিমালার ফলে সেই জমিতে ১৪ তলা ভবন হচ্ছে। অবশ্য নতুন খসড়া ড্যাপে প্রস্তাব করা হয়েছে, গণপরিসর বা সাধারণ মানুষের জন্য জায়গা না ছাড়লে ব্যক্তি পর্যায়ে ধানমন্ডিতে ৮ তলার ওপরে আর ভবন নির্মাণ করা যাবে না। নতুন ড্যাপে আবাসিক ভবনের উচ্চতাসংক্রান্ত প্রস্তাবটি শুধু ধানমন্ডি নয়, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ঢাকা শহরের সব এলাকার জন্য প্রযোজ্য হবে। আর রাজউকের আওতাধীন নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এবং সাভার পৌর এলাকায় আবাসিক ভবন হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন