শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

রাজউকের চেয়ারম্যান ‘ম্যাজিক চেয়ার’

সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ গ্রাহক স্থায়ী চাকরিজীবীদের ছকে বাধা জীবন প্রমোশন নেই

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ১০ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

‘রাজউকের চেয়ারম্যান’ চেয়ারটি যেন হয়ে গেছে সরকারি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রমোশন পাওয়ার ম্যাজিক চেয়ার। যারাই এ চেয়ারে বসছেন যোগদানের ৬ মাস থেকে এক বছরের মধ্যে পদোন্নতি পেয়ে চলে যাচ্ছেন। সরকারের গুরুত্বর্পূণ সেবামুলক প্রতিষ্ঠানে স্থায়ী পদ সৃষ্টি না হওয়া ও জনবল নিয়োগ এবং পদোন্নতি না দেয়ার কারণে এক দিকে জনগণ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অন্যদিকে সরকারের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে হিমসিম খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। আবার মন্ত্রণালয় থেকে সেব কর্মকর্তার বদলীয় হয়ে রাউজকে যোগদান করছেন দুই থেকে চার মাসের মধ্যে তারা নিজেদের প্লটও ফ্ল্যাট বরাদ্ধ নিয়ে পরে বদলীয় হয়ে চলে যাচ্ছেন। রাজউক থেকে বড় বড় কর্মকর্তাদের ঘন ঘন বদলী করার কারণে এক দিকে যেমন সরকারে নীতি বাস্তবায়ন এবং উন্নয়ন থমকে যচ্ছে না; অন্যদিকে সরকার কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে।

জানা গেছে, দক্ষ প্রকল্প কর্মকর্তা না থাকায় রাজধানীর বনানী-গুলশাল লেক উন্নয়ন প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্প ২০ থেকে ৩০ বছরেও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণকৃত জমির মালিকরা বছরে পর বছর টাকা পাচ্ছে না। টাকার জন্য জমির মালিকরা শুধু রাজউকের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন বলে জানা গেছে। আবার জনগণ হয়রানী থেকে প্রতিকারও পাচ্ছে না। গত কয়েক বছরে যারা রাজউক চেয়ারম্যান হয়েছে আবার পরিবর্তন হয়েছেন। তাদের মধ্যে পরিকল্পনা বিভাগে সংযুক্ত প্রধান (শিল্প ও শক্তি বিভাগ) ড. সাঈদ হাসান শিকদার তিন মাসও অফিস করতে পারেনি। তার আগে রাজউক চেয়ারম্যানের দায়িত্ব চালিয়ে আসা মোহাম্মদ সাঈদ নুর আলম ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) গেছেন। এপ্রিল মাসে অতিরিক্ত সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরীকে রাজউক চেয়ারম্যান করা হয়। তিনি পরে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব পদোন্নতি পান। এর পর গত মে মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আনিছুর রহমান মিঞাকে প্রেষণে রাজউক চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি গত ৪ জুন মাসে যোগদান করেছেন।এবার বর্তমান চেয়ারম্যান সচিব হয়েছে। তিনিও বেশিদিন রাজউকে থাকছেন না। এ ভাবে কর্মকর্তা আসছেন আবার যাচ্ছেন। সরকারে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কিছুই হচ্ছে না।

এছাড়া গত ২০ বছর আগে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (রাজউক) ‹কাজ নেই মজুরি নেই› (কানামনা) ভিত্তিতে মাস্টাররোলে নিয়োগ পেয়েছিলেন ৮৪ কর্মচারী। কয়েক বছরের মধ্যেই এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৮৩ জনে। তাদের মধ্যে ১৪৭ কর্মচারীর চাকরি স্থায়ী হয়েছে। বাকি কর্মচারীরা এখনও ওয়ার্কচার্জভুক্ত হিসেবে চাকরি করে যাচ্ছেন। নিয়মিত হওয়া কর্মচারীদের অনেকে ধাপে ধাপে কর্মকর্তাও হয়েছেন। পদোন্নতি পেয়েছেন। কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের সর্বশেষ পাঁচজনকে উপসচিব পদমর্যাদায় তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদে পদোন্নতি দেওয়ার। পদোন্নতির ক্ষেত্রে ‘ জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন› হওয়ায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে তীব্র ক্ষোভ, অসন্তোষ ও হতাশা। বাংলাদেশ সার্ভিস রুলসের ‹সরকারি কর্মচারীদের বদলির সাধারণ শর্তাবলি› অনুচ্ছেদের ১ নম্বর ধারায় বলা আছে,একই পদে তিন বৎসর অতিক্রান্ত হওয়ার অব্যবহিত পূর্বেই মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও উহার অধীনস্থ দপ্তর/পরিদপ্তরসমূহের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাগণকে নতুন পদে/স্থানে বদলি করিতে হইবে। ২ নম্বর ধারায় বলা আছে, ‹কর্মকর্তা ও কর্মচারী সকলের ক্ষেত্রে উক্ত আদেশ প্রযোজ্য হইবে যদি বর্তমানে প্রচলিত নিয়মানুযায়ী পদটি বদলিযোগ্য হইয়া থাকে।› কিন্তু রাজউকে এটা কখনোই অনুসরণ করা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, এর পেছনে অনেক বড় বাণিজ্য রয়েছে। যাঁরা থাকেন তাঁরাও সুবিধাভোগী, যাঁরা তাঁদের রাখেন তাঁরাও সুবিধাভোগী। উভয়ের মধ্যে ভালো বোঝাপড়া থাকার কারণে তাঁরা সুবিধা পান আর ভোগান্তিতে পড়েন সেবাগ্রহীতারা।

এবিষয়ে রাজউকের চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা ইনকিলাবকে বলেন, কি কারণে ভাল কর্মকর্তরা রাজউকে আসতে চায় না সেটা বলা যাবে না। তবে যারা আসছেন তারা সবাই ভাল লোক। সরকারে প্রয়োজনের কর্তকর্তাদের তুলে নেয়া হয়। আর কাকে দিবে সেটা সরকারে সিদ্ধান্ত। আমি বলতে পাবো না। অধিগ্রহণ করা প্রকল্পের জমির টাকা কি কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মালিকরা পাচ্ছে না এমন প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, বিষয়ট ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, কারা দীর্ঘদিন একই স্থানে কর্মরত- এ ধরনের কর্মকর্তা-কর্মচারীর তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন। ইতোমধ্যে কয়েকজনের তালিকা হাতে পেয়েছেন। কিন্তু কয়েকজনকে বদলি করলে তখন বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে বিধায় এ ধরনের যাঁরা আছেন তাঁদের সবাইকে একসঙ্গে আন্তঃবদলি করা হবে। তখন কেউ আর এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবেন না। এক মাসের মধ্যে এটা করা হবে। তিনি আরও বলেন, আগে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা না নেওয়ায় সংকটের একটি স্তূপ তৈরি হয়েছে।
জানা গেছে, গত ১৯৫৩ সালে প্রণীত আইনের আওতায় ১৯৫৬ সালে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহের উন্নয়ন ও পরিবর্ধনের বিশেষ ক্ষমতা নিয়ে সর্ব প্রথম “ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট” (ডিআইটি) প্রতিষ্ঠিত হয়। ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে পরিচালিত তৎকালীন ডিআইটি পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে উক্ত আইন সংশোধনের মাধ্যমে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) হিসেবে পরিবর্তিত হয়। ১৯৫৯ সালে ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি) কর্তৃক সর্ব প্রথম ঢাকার মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়। ১৯৯৫ সালে ঢাকা মহানগর উন্নয়ন পরিকল্পনা এর আওতায় ৫৯০ বর্গমাইল এলাকার কৌশলগত পরিকল্পনা এবং ২০১০ সালে ডিটেল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রনয়ন করা হয়। পরে চলতি বছর ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার জন্য প্রণীত মাস্টারপ্ল্যান ২০৩৫ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়িয়ে সংশোধিত মাস্টারপ্ল্যান ড্যাপের গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। বর্তমানে চেয়ারম্যান এবং পাঁচ জন সদস্য পর্ষদের পরিচালনায় রাজধানী ঢাকা ও এর আশেপাশের শহরাঞ্চল ও পশ্চাদভূমি নিয়ে গঠিত ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা নিয়ে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রাজউক রাজধানী ঢাকার পরিকল্পনা, উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু দক্ষ কর্মকর্তা না থাকার কারণে উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্জন করতে পারছে না এ সংস্থাটি।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) টেলিফোন অপারেটর তরিকুল ইসলামের দায়িত্ব সেবাগ্রহীতাদের টেলিফোন ধরা এবং কর্মকর্তাদের প্রয়োজনে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ইন্টারকমে ফোন ধরিয়ে দেওয়া। বিভিন্ন বিভাগ, শাখা বা আঞ্চলিক কার্যালয়ে এ দায়িত্ব পালন করবেন তিনি। অথচ সাত বছর ধরে রাজউকের জোন-১ এস্টেট (সম্পত্তি) শাখায় অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত তরিকুল। কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে এ পদে দায়িত্ব নিয়েছেন। কারণ, এস্টেট শাখায় থাকলে প্লটের ফাইলপত্র নাড়াচাড়া করে কিছু বাড়তি কামানো যায়। এ জন্য এ শাখা ছাড়তে চান না তিনি। ফলে শীর্ষ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বছরের পর বছর একই স্থানে রয়েছেন এ টেলিফোন অপারেটর। রাজউক থেকে মাস্টাররোলে নিয়োগ পেয়ে নিয়মিত কর্মকর্তা হওয়া পাঁচজনকে আবারও উপসচিব পদমর্যাদায় পদোন্নতি দেওয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে। তারা হলেন- নির্বাহী প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম, উজ্জ্বল মল্লিক, মোজাফফর আহমদ, আমিনুর রহমান সুমন ও আবদুল লতিফ হেলালী। তারা বিএনপি সরকারের আমলে সহকারী প্রকৌশলী পদে মাস্টাররোলে নিয়োগ পেয়েছিলেন।

রাজউকের ওয়ার্কচার্জভুক্ত কর্মচারী কার্য তদারককারী মোহাম্মদ শফিউল্লাহ বাবু, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মোশাররফ হোসেন স্কাই ইনকিলাবকে বলেন, ১৯৯৬ সালের ৮৪ জন অনিয়মিত কর্মচারীর সবাই নিয়মিত হয়েছেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ের কর্মচারীদের নিয়মিত করা হচ্ছে না। এ রকম শ-খানেক কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন, যাঁদের একই স্থানে তিন বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও বদলি করা হয়নি।

এ প্রসঙ্গে রাজউকের বোর্ড সদস্য (প্রশাসন) মুহম্মদ কামরুজ্জামান ইনকিলাবকে বলেন, মাস্টাররোল থেকে নিয়মিত হলেই কর্মচারীরা রাজউকের নিয়মিত জনবল বিবেচিত হন। সেখানে জ্যেষ্ঠতার তালিকা অনুসরণ করেই পদোন্নতি দেওয়া হবে। কেউ বঞ্চিত হলে সেটাও রাজউক পর্যালোচনা করবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন