রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। জমি বরাদ্দ নামজারি, বাড়িঘরের নকশা ও প্লান অনুমোদন ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে এই জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীরা বলে থাকে, রাজউকে কোনো কাজই বিনা হয়রানিতে, বিনা ঘুষে হয় না। এর ডেস্কে-ডেস্কে, স্তরে-স্তরে অনিয়ম-দুর্নীতি বাসা বেঁধে আছে। টাকা না দিলে কোনো ফাইল নড়ে না। ভুক্তভোগীদের দিনের পর দিন ঘুরতে ঘুরতে হয়রান- পেরেশান হয়ে যেতে হয়। টাকা দিলে ফাইলে গতি আসে। রাজউকে যতটুকু কাজ হয়, সেটা এভাবেই। এই অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে। এতে অবস্থার পরিবর্তন তেমন হয়নি। বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। রাজউক আয়োজিত খসড়া ড্যাব সংক্রান্ত জাতীয় সেমিনারে তিনি বলেছেন, রাজউকের বিরুদ্ধে প্রতিদিন আমার কাছে শত শত অভিযোগ আসে। জনগণ সেবা পাচ্ছে না। জনসেবা নিশ্চিত করার জন্য তিনি গণপূর্ত প্রতিমস্ত্রী, সচিব ও রাজউক চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আরো বলেছেন, রাজউকের সেবা ডিজিটাল বা অনলাইন করা দরকার। ভূমি মন্ত্রণালয়ের অনলাইনে নামজারি করা শুরু হয়েছে। সেই তুলনায় রাজউকের কাজ কম। রাজউক অনলাইনে কাজ করলে অভিযোগ অনেক কমে আসবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, সরকারের অনেক অফিস, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান অনলাইনে কাজ করলেও রাজউকের মতো প্রতিষ্ঠান পিছিয়ে কেন? ঘুষ-বাণিজ্য বহাল রাখার জন্যই কি?
কে না জানে, রাজধানীর ডিটেইল এরিয়া প্লান (ড্যাব) রাজউকের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। রাজধানীকে মনোহর ও বাসযোগ্য করতে এই বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা শুধু অত্যাবশক নয়, জরুরিও বটে। অথচ, এজন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হচ্ছে। ড্যাবের গেজেট প্রকাশিত হয় ২০১০ সালে। প্রথমবারের মতো প্রকাশিত এই ড্যাবে নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অসম্পূর্ণতা ধরা পড়ে। পরে ২০১৫ সালে ২০ বছর মেয়াদের সংশোধিত ড্যাব প্রণয়নের কাজ শুরু হয়, যা এখন শেষ পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। রাজউক চেয়ারম্যান জাতীয় সেমিনারে জানিয়েছেন, বাসোপযোগী ঢাকা গড়তে ড্যাবে বিভিন্ন ধরনের সুপারিশ ও নতুনত্ব আরোপ করা হচ্ছে। দুর্যোগকালীন ভূমির ব্যবহার, জনঘনত্ব, ব্লক বেইজ উন্নয়ন, মৌজাভিত্তিক ম্যাপ, নিম্নআয়ের লোকদের জন্য আবাসনের সুপারিশ থাকছে। ড্যাব (২০১৬-২০৩৫) প্রকল্পের পরিচালক জানিয়েছেন, ১ হাজার ৫২৮ বর্গকিলোমিটারে ড্যাব প্রণীত হচ্ছে। প্রকল্প এলাকাকে ৬টি স্বতন্ত্র প্রধান অঞ্চল এবং ৭৫টি উপঅঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। তার ভাষায়, এবারের পরিকল্পনায় বিনিয়োগের সার্বজনিন স্বাধীনতা, উন্নত জীবনমান, সহনশীল শহর, বাস্তুসংস্থান সংরক্ষণ ও পুনরুজীবনকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য, কোনো পরিকল্পনা শতভাগ নিখুঁত হবে, এটা কেউ আশা করে না এবং হয়ও না। তবে শতভাগ নিখুঁতের কাছাকাছি হলে সেটা গ্রহণযোগ্য হয় এবং তাতে প্রকল্প থেকে কাক্সিক্ষত সুবিধা লাভ করা সম্ভবপর হয়। রাজউক প্রথম ড্যাব প্রণয়নে কয়েক বছর সময় নিয়েছে, যা কাজে আসেনি। সংশোধিত ড্যাব প্রণয়নেও প্রায় ৫ বছর চলে গেছে। এই সংশোধিত ড্যাব চূড়ান্ত করতে আর কতদিন লাগবে, সেটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। হয়তো খুব শিগগিরই চূড়ান্ত করা ড্যাবের গেজেট প্রকাশিত হবে। আবার কোনো কারণে বিলম্বিতও হতে পারে। সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা যে অভিমত দিয়েছেন তার মধ্যে অভিযোগের সুর ধ্বনিত হয়েছে। তাদের দেয়া সুপারিশ সংশোধিত ড্যাবে স্থান পায়নি বলে কেউ কেউ অভিযোগ করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, খসড়ায় ২৬ শতাংশ জলস্রোতের মধ্যে মূল জলস্রোত দেখানো হয়েছে মাত্র ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। বাকীটা সাধারণ জলস্রোত। সাধারণ জলস্রোত মানে, সেখানে স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে। এ বক্তব্য থেকে মনে হয়, ঢাকার নদনদী, খাল ও জলাশয়ের প্রতি যথেষ্ট সুবিচার করা হয়নি। এনিয়ে সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন উঠবে। প্রশ্ন উঠবে ড্যাব কতটা পরিবেশবান্ধব হয়েছে, তা নিয়েও।
উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না, ঢাকা সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা মাফিক গড়ে ওঠা কোনো শহর নয়। শহরটি গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত ও অগোছালোভাবে। এই অপরিকল্পিত শহরকে যতটা সম্ভব পরিকল্পনার আওতার আনাসহ এর সম্প্রসারিত অংশকে যথাযথভাবে গড়ে তোলা নিশ্চিত করতে হবে। এই নিরিখে ড্যাবের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কতটা অপরিহার্য, সেটা বুঝা যায়। আমরা বাসযোগ্য, অনুকূল, পরিবেশবান্ধব যে ঢাকা চাই, তার জন্য উপযেগী ড্যাবও চাই। এজন্য আর সময় দেয়ার সময় নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটি চূড়ান্ত ও অনুমোদন করতে হবে। কাজ শুরু করতে হবে অনতিবিলম্বে। কাজ শুরুতে বিলম্ব হলে শেষ করতেও বিলম্ব হবে। আর অধিক বিলম্ব প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা ও উপযোগিতাকে অনেকাংশে হ্রাস করবে, যা কাম্য হতে পারে না। রাজউকের মতো জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই অনিয়ম-দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হতে হবে। রাজউকের ইট-কাঠও ঘুষ খায়, আমরা এ ধরনের কথা শুনতে চাই না। আমরা আশা করবো, রাজউককে অনিয়ম-দুর্নীতিমুক্ত ও গণমুখী করতে যথোচিত কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নিরপেক্ষ বা বিশদ তদন্তের মাধ্যমে অনিয়ম-দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন