শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সারা বাংলার খবর

গোপন প্রক্রিয়ায় বিক্রি হয়ে যাচ্ছে রাজউকের জমি

নারায়ণগঞ্জ থেকে মোঃ হাফিজুর রহমান মিন্টু | প্রকাশের সময় : ১৭ নভেম্বর, ২০২১, ২:০২ পিএম

নারায়ণগঞ্জ শহরের উন্নয়নের লক্ষে তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার (বর্তমান নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন) কাছ থেকে প্রায় ২৪ দশমিক ১৮ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল তৎকালীন ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট তথা ডিআইটি (বর্তমান রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তথা রাজউক)। নিয়ম অনুযায়ী ওই জমি রাজউকের কাজে না লাগলে, হয় জায়গাগুলো ফেরত দেবে অথবা রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহারের জন্য অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে দেবে।
আইনগতভাবে এই জায়গা রাজউক বিক্রি করতে পারে না। অথচ রাজউক এসব নিয়মের তোয়াক্কা না করে সেসব জমি ব্যক্তি পর্যায়ে বিক্রি করে দিয়েছে। জমি বিক্রির এই কার্যক্রম চলেছে গোপনে। রাজউকের এই জমি বিক্রির প্রক্রিয়ায় লাভবান হচ্ছে প্রভাবশালী একটি মহল। তবে নগরবাসীর স্বার্থে এসব জমি উদ্ধারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী।

সূত্রমতে, ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি) প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৫৬ সালে। ১৯৮৭ সালে এটি উন্নীত হয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (রাজউক)। ডিআইটি তৎকালীন নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার মালিকানাধীন প্রায় ২৪ দশমিক ১৮ একর জমি পৃথক নয়টি এলএ কেইস মূলে অধিগ্রহণ করে। শহরের উন্নয়নের স্বার্থে এইসব জমি অধিগ্রহণের পর বঙ্গবন্ধু সড়ক, নবাব সলিমুল্লাহ সড়কসহ চাষাঢ়া বালুর মাঠে মোট ১৭৫টি প্লট তৈরি করে

কথা ছিল, এসব জমি রাজউকের কাজে না লাগলে, হয় জায়গাগুলো ফেরত দেবে অথবা রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহারের জন্য অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে দেবে। ২০০৮ সালে সলিমুল্লাহ সড়ক ও খানপুর শিল্প এলাকার কিছু প্লট বিক্রির জন্য টেন্ডার আহŸান করে রাজউক। এসব প্লট বাণিজ্যিক আকারে বিক্রি না করে তাদের অনুক‚লে হস্তান্তরের জন্য হাইকোর্টে পৃথক দু’টি রিট পিটিশন ও মামলা দায়ের করে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা। ২০১৭ সালের ২ আগস্ট এই টেন্ডার নোটিশটি স্থগিতাদেশ প্রদান করেন হাইকোর্ট।
অধিগ্রহণ করা জমিসহ ছয়টি বিপনীবিতান কেন বর্তমান নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের (নাসিক) অনুক‚লে কেন ফেরত দেয়া হবে না মর্মে রুল জারি করেন। অথচ এই আদেশের মাত্র এক মাস পরেই চাষাঢ়া বালুর মাঠ সংলগ্ন ভাষা সৈনিক সড়কের পাশে ১২ নম্বর প্লটের জমি নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি খালেদ হায়দার খান কাজলের কাছে বিক্রি করে দেয় রাজউক।

সূত্র আরও জানায়, ২০১৫ সালের ৩ মার্চ গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী রাজউকের ভূমি পরিদর্শন শেষে নারায়ণগঞ্জ নগরভবনে যান। সেখানে সিটি মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও সংশ্লিষ্টদের সাথে আলোচনার এক পর্যায়ে ছয়টি বিপনীবিতানসহ চাষাঢ়া বালুর মাঠের কার পার্কিংয়ের প্লট ও অবিক্রিত প্লটসমূহ নাসিকের অনুক‚লে হস্তান্তরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে আশ্বস্ত করেন। তবে হাইকোর্টের নির্দেশ ও মন্ত্রীর মৌখিক নির্দেশকে উপেক্ষা করে শহরের কয়েকটি প্লট বিক্রি করে দিয়েছে রাজউক। এ নিয়ে আদালতে সিটি কর্পোরেশন মামলাও করেছে। যা এখনও বিচারাধীন।

জানা যায়, ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর রাজউকের অধিগ্রহণকৃত নকশায় গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য নির্ধারিত হয় চাষাঢ়া বালুর মাঠ সংলগ্ন ভাষা সৈনিক সড়কের পাশে ১২ নম্বর প্লট। হাইকোর্টের নির্দেশ ও মন্ত্রীর মৌখিক নির্দেশকে উপেক্ষা করে সেই প্লটে সিটি কর্পোরেশনের মাইক্রোস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করে ২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ৫৭৭৬নং দলিলের মাধ্যমে ২১ দশমিক ৫৪ শতাংশ জমি নারায়ণগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি খালেদ হায়দার খান কাজলের কাছে বিক্রি করে রাজউক
২০১৮ সালের ২৩ মে কাজল ওই জমি ১৪ কোটি টাকায় বিক্রি করে পপুলার ডায়গনস্টিক সেন্টার লিমিটেডের কাছে। একইভাবে ২০১৬ সালের ২৭ জুলাই রাজউক চাষাঢ়ার মনির টাওয়ার সংলগ্ন ২৪ নম্বর প্লটে নাসিকের অস্থায়ী মার্কেট উচ্ছেদ করে প্রায় ৭ শতাংশ জমি ২ কোটি ৬৮ লাখ ৪৮ হাজার ২৪৭ টাকায় মহিউদ্দিন তোরান ও দুলাল চন্দ্র ভৌমিকের কাছে বিক্রি করে দেয়।

ওই জমিতে বর্তমানে ৮ তলাবিশিষ্ট বাণিজ্যিক ভবন রয়েছে। একইভাবে ২০১৬ সালের ২২ নভেম্বর পপুলার ডায়গনস্টিক সেন্টারের পশ্চিম পাশের প্রায় ৫৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ জমি পৃথক দুই দলিলের মাধ্যমে আমলাপাড়ার নুপুর কুমার ভৌমিকের কাছে ১৭ কোটি ১ লাখ ১১ হাজার ৮৪৫ টাকায় বিক্রি করে দেয় রাজউক। পরে নুপুর কুমার ভৌমিক সেই জমি পপুলার ডায়গনস্টিক সেন্টারের পক্ষে প্রতিষ্ঠানের এমডি ডা. মোস্তাফিজুর রহমানের কাছে ২৭ কোটি ৪৩ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করে। বর্তমানে ওই জমি খালি রয়েছে।

ভূমি অধিগ্রহণ আইন ১৯৮২ এর ১৭নং ধারা মোতাবেক এসব জমি সরকারি বা আধাসরকারি সংস্থার কাছে হস্তান্তর না করে প্লট আকারে বিক্রি করে দেওয়ায় হতবাক নগরবাসী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগর উন্নয়ন মূল কাজ হলেও রাজউকের সেদিকে মনোযোগ কম। ফলে তারা উন্নয়নের নামে জমি অধিগ্রহণ করে পরে তা প্লট করে বিক্রি করে দিয়েছে। এদিকে এইভাবে বেহাত হয়ে যাচ্ছে শহরের সরকারি জমি। জমি বিক্রির এই কার্যক্রম চলেছে গোপনে। নগরবাসীকে অজ্ঞাত রেখে এই জমি বিক্রি করে দিয়েছে রাজউক

তবে এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। নগরবাসীর উন্নয়নের স্বার্থে তিনি জমিগুলো ফেরত পেতে আদালতের শরনাপন্ন হয়েছেন। এই বিষয়ে আদালতে মামলা প্রকিয়াধীন রয়েছে। এদিকে জানা যায়, ২০০৮ সালে ৬৩টি প্লট বিক্রির বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল রাজউক। তখন নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির আন্দোলনের মুখে প্লট বিক্রি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল সংস্থাটি। এ বিষয়ে নাগরিক কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি রফিউর রাব্বি বলেন, রাজউক এই জায়গাগুলো নারায়ণগঞ্জের মানুষের কাছ থেকেই অধিগ্রহণ করেছিল। রাজউকের কাজে না লাগলে, হয় জায়গাগুলো ফেরত দেবে অথবা রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যবহারের জন্য অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানকে দেবে। আইনগতভাবে এই জায়গা রাজউক বিক্রি করতে পারে না।

এই বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী জানান, ১৯৬৫ সালে তৎকালীন ডিআইটি (বর্তমানে রাজউক) নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার প্রায় ২৪ একর জমি জনস্বার্থে ব্যবহার ও উন্নয়নের জন্য অধিগ্রহণ করে। ১৯৮২ সালে তৎকালীন সরকার ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম ডিআইটির অধিগ্রহণ করা অব্যবহৃত জায়গা ও মার্কেট সংশ্লিষ্ট পৌরসভাগুলোকে ফেরত দিতে বলে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম পৌরসভাকে দেওয়া হলেও ডিআইটি নারায়ণগঞ্জ পৌরসভাকে জায়গা ফেরত দেয়নি।
সরকারি জমির এমন হাতবদল ঠেকাতে নারায়ণগঞ্জবাসীর স্বার্থে লড়ছেন নাসিক মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। তিনি ওইসব জমি নারায়ণগঞ্জ শহরের বাসিন্দারের কল্যাণে ব্যবহার করতে চান। ফলে তাকে প্রভাবশালী একটি ভূমিদস্যু চক্রের মুখোমুখি হতে হয়েছে একাধিকবার। জমির এই জমির হাতবদল ঠেকাতে গিয়ে ভুক্তভোগী হতে হয়েছে নাসিক মেয়রকে

তাকে একাধিকবার ভূমিদস্যু প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে তাতে দমে যাননি তিনি। বেহাত হওয়া জমি উদ্ধারে আদালতে লড়ে যাচ্ছেন তিনি। এদিকে এই বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিবের সভাপতিত্বে একাধিক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওইসব সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর পুনরায় আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে

নগরবাসীর অভিমত, রাজউক জায়গা বিক্রি না করে এখানে শিশুদের জন্য পার্ক, মাঠ, হাসপাতাল কিংবা স্কুল নির্মাণ করে দিতে পারতো কিংবা সিটি কর্পোরেশনে হস্তান্তর করলে তারাই নগরবাসীর স্বার্থে কাজ করতে করতো। এদিকে নগরবাসীর স্বার্থে ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে অবস্থান করায় প্রশংসিত মেয়র আইভী।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন