মুসলিম-সমাজে যখন অজ্ঞতা ও বিজাতির সংশ্রব একত্র হয়েছে, তখন ভিন্ন সমাজের রোগ-ব্যাধি ও রীতি-রেওয়াজে আক্রান্ত হওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়। সকল অন্যায় ও প্রান্তিকতা এবং শোষণ ও নির্যাতনমূলক রীতি-নীতি থেকে সম্পূর্ণমুক্ত ও পবিত্র আদর্শ ইসলামকে পেয়েও যারা সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করে না এবং বিজাতির অন্ধ অনুকরণের মোহ কাটাতে পারে না, শুধু আদম-শুমারির মুসলমানিত্ব কি পারবে ঐ সকল মরণ-ব্যাধি থেকে তাদেরকে রক্ষা করতে?
বর্ণবাদী হিন্দু ও ভোগবাদী ইংরেজের সংশ্রব থেকে উদাসীন মুসলমানদের মাঝে একদিকে যেমন অবিশ্বাস ও পৌত্তলিকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে অন্যদিকে অনাচার ও অশ্লীলতা এবং বহু নিপীড়নমূলক প্রথারও বিস্তার ঘটেছে। তবে ফিকরী কুফর ও চিন্তাগত অবিশ্বাসের তালিকায় সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে সেক্যুলারিজম আর সামাজিক প্রথা ও প্রচলনের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক বস্তু হলো যৌতুক। এর একটি যদি হয় চিন্তা ও মস্তিষ্কের পচন তো অন্যটি সমাজ-দেহের ক্যান্সার। একটি দ্বীন ও ঈমানের ঘাতক তো অন্যটি পারিবারিক শান্তি ও সামাজিক শৃঙ্খলার মৃত্যুদূত। এই দুই বস্তুর প্রথমটি হচ্ছে ইংরেজের উত্তরাধিকার আর দ্বিতীয়টি হিন্দু-সমাজের আশীর্বাদ।
দ্বিতীয় ব্যাধিটি সম্পর্কেই বর্তমান নিবন্ধে কিছু কথা বলার ইচ্ছা করছি। মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটি কথা। তা এই যে, আরবীতে একটি শব্দ আছে ‘জাহায’, যার উর্দু তরজমা করা হয় জাহীয। কেউ কেউ অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই এই শব্দের তরজমা করেন যৌতুক। যা সঠিক নয়।
জাহায বা জাহীয হচ্ছে, কন্যাকে দেওয়া পিতার উপহার। স্বামী বা শ্বশুরালয়ের কেউ এর মালিক নয়, এর মালিক কন্যা নিজে। পিতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কন্যাকে তা দিয়ে থাকে। এতে স্বামী ও শ্বশুরালয়ের দাবি ও চাপাচাপি তো দূরের কথা, কন্যার পক্ষ থেকেও কোনো দাবি থাকে না। এটা নামধামের জন্য দেওয়া হয় না। যৎসামান্য উপহার পিতা নিজের সামর্থ্য অনুসারে কন্যাকে দিয়ে থাকেন।
এই উপহারও বিয়ের সময় দেওয়া সুন্নত, মুস্তাহাব নয়; নিছক মোবাহ, যদি না কোনো সামাজিক চাপ কিংবা প্রথাগত বাধ্য-বাধকতা থাকে। অন্যথায় তা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম হয়ে যায়। হাদীস শরীফে আছে, নবী (সা.) বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছেন : সাবধান! কারো জন্য তার ভাইয়ের কিছুমাত্র সম্পদও বৈধ নয়, যদি তার স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি না থাকে। (মুসনাদে আহমদ : ১৫৪৮৮)।
অর্থাৎ কেউ কিছু দিলেই তা ভোগ করা হালাল হয় না, যে পর্যন্ত না খুশি মনে দেয়। পুত্র-কন্যাও এ বিধানের বাইরে নয়। সুতরাং পিতা যদি বাধ্য হয়ে নিজের কন্যাকেও কোনো কিছু দেয় তবে তা গ্রহণ করা তার জন্যও বৈধ নয়। তাহলে স্বামী বা শ্বশুরালয় থেকে যদি কন্যার উপহার দাবি করা হয় কিংবা কোনো তালিকা দেওয়া হয় তাহলে তা কীভাবে বৈধ হবে? এ তো মোবাহ জাহিয নয়. সরাসরি যৌতুক।
কেউ কেউ রোখসতির সময় কন্যাকে কিছু উপহার, কিছু ঘরকন্নার সামগ্রি দেওয়াকে মাসনূন মনে করেন। এ প্রসঙ্গে সীরাতের একটি ঘটনা উল্লেখ করা হয় যে, রাসূলে কারীম (সা.) নিজ কন্যা ফাতিমা (রা.) কে রোখসতির সময় কিছু জিনিস দিয়েছিলেন। মুসনাদে আহমদ (হাদীস : ৬৪৩) ও সহীহ ইবনে হিববানে (হাদীস : ৬৯৪৭) এ তিনটি বস্তুর কথা আছে। একটি ঝুলদার চাদর, একটি পানির মশক ও একটি বালিশ, যাতে ইযখির ঘাসের ছোবড়া ভরা ছিল। মুসনাদে আহমদের এক রেওয়ায়েতে (হাদীস : ৮৩৮) দুটি ঘড়া ও দুটি যাঁতার কথাও আছে।
কিন্তু উসূলে ফিকহের বিধান মতে শুধু এইটুকু ঘটনার দ্বারা কোনো আমল মাসনূন প্রমাণিত হয় না, শুধু মোবাহ বা বৈধ প্রমাণিত হয়। ওই কাজ মাসনূন হলে নবী (সা.) তাতে উৎসাহিত করতেন এবং তাঁর অন্য কন্যাদের বিয়েতেও এ ধরনের উপহার দিতেন। তেমনি উম্মুল মুমিনীনদেরও তাদের পিত্রালয় থেকে উপহার দেওয়া হত। কিন্তু কোনো রেওয়ায়েতে এমন কোনো কিছুই পাওয়া যায় না। শুধু উম্মে হাবীবা (রা.) সম্পর্কে পাওয়া যায়, তাঁর জন্য হাবাশার বাদশা নাজাশী নিজের পক্ষ থেকে কিছু উপহার পাঠিয়েছিলেন। (সুনানে নাসায়ী : ৩৩৫০)।
ফাতেমা (রা.)-এর ঘটনার আরেকটি দিকও রয়েছে, যা বিবেচনা করা দরকার। তা এই যে, নবী (সা.) ছিলেন হযরত আলী (রা.)-এরও অভিভাবক। সুতরাং সম্ভাবনা আছে যে, ওই জিনিসগুলো তিনি পাঠিয়েছিলেন আলী (রা.)-এর পক্ষ থেকে। কারণ বিয়ের সময় তাঁর ঘরে ওই ধরনের কোনো আসবাবপত্র ছিল না। মুসনাদে আহমদ (হাদীস : ৬০৩) সহ বিভিন্ন কিতাবে নির্ভরযোগ্য সনদে এই তথ্য রয়েছে। মাওলানা মুহাম্মাদ মনযূর নুমানী (রাহ.) মাআরিফুল হাদীস (৩/৪৬০-৪৬১) এই ব্যাখ্যাই করেছেন।
মোটকথা, রোখসতির সময় মেয়েকে কিছু উপহার দেওয়া বা ঘরকন্নার প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রদান করাকে কোনো সাহাবী ও তাবেয়ী মাসনূন বা মুস্তাহাব বলেছেন, এমন তথ্য আমার জানা নেই। ফিকহ-ফতোয়ার নির্ভরযোগ্য কিতাবের মোহর-অধ্যায়ের মাসায়েল থেকে এর বৈধতাটুকুই প্রমাণিত হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন