শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম

যৌতুক এক অভিশপ্ত সামাজিক ব্যাধি, বহু কবিরা গোনাহর সমষ্টি-২

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক | প্রকাশের সময় : ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:০৩ এএম, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

কন্যার বিয়ে বা তার স্বামীর বাড়িতে যাওয়ার সময় পিতা নিজ সাধ্য অনুসারে তাকে যে গহনাগাটি বা সামানপত্র শুধু আল্লাহর রেযামন্দির জন্য উপহার দেয় যাকে আরবীতে বলে জাহায এবং উর্দুতে যার তরজমা জাহীয শব্দ দ্বারা করা হয়, একে মোবাহ বা মুস্তাহাব যাই বলুন না কেন, প্রচলিত যৌতুকের সাথে এর বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। এটা উর্দু ভাষার সীমাবদ্ধতা যে, তাতে যৌতুকের জন্যও জাহীয শব্দ ব্যবহার করা হয়। আর মূল আরবীতে তো যৌতুকের সমার্থক কোনো শব্দই নেই। কারণ সম্ভবত এই যে, ইসলামী যুগে তো দূরের কথা, জাহেলী যুগেও আরব-সমাজে আর যা কিছুই ছিল, যৌতুকের অভিশাপ ছিল না। সম্প্রতি আরবরা একটি বিদেশি শব্দের অপভ্রংশ ‘দাওতা’ যৌতুকের জন্য ব্যবহার করে থাকে।

যৌতুক শব্দের মূল প্রয়োগে কতটুকু ব্যাপকতা আছে তা আমার জানা নেই। তবে এখন তা একটি পরিভাষা। বিয়ের সময় বা বিয়ের আগে-পরে যে কোনো সময় কনে বা কনেপক্ষের কাছে থেকে বর বা বরপক্ষের লোকেরা যে সম্পদ বা সেবা গ্রহণ করে কিংবা সামাজিক প্রথার কারণে তাদের দেওয়া হয়, তদ্রূপ কনে বা কনেপক্ষের লোকরা মোহর ও ভরণপোষণের অধিক যা কিছু উসূল করে বা সামাজিক প্রথার কারণে তাদের দেওয়া হয় এই সবই যৌতুক। এটিই বর্তমান নিবন্ধের বিষয়বস্তু।

যৌতুকের লেনদেন এত জঘণ্য অপরাধ যে, তা শুধু হারাম বা কবিরা গোনাহ নয়, এমন অনেকগুলো হারাম ও কবিরা গোনাহর সমষ্টি, যার কোনো একটিই যৌতুকের জঘণ্যতা ও অবৈধতার জন্য যথেষ্ট ছিল। যৌতুকের সবচেয়ে নগণ্য দিক হলো, তা একটি হিন্দুয়ানি রসম বা পৌত্তলিক সমাজের প্রথা। আর কোনো মুসলিম কোনো অবস্থাতেই কাফের ও মুশরিকদের রীতিনীতি অনুসরণ করতে পারে না।

যৌতুক শুধু জুলুম নয়, অনেক বড় জুলুম। আর তা শুধু ব্যক্তির উপর নয়, গোটা পরিবার ও বংশের উপর জুলুম। যৌতুকের কারণে কনে ও তার অভিভাবকদের যে মানসিক পীড়ন ও যন্ত্রণার শিকার হতে হয় তা তো ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। অথচ কাউকে সামান্যতম কষ্ট দেওয়া ও জুলুম করাও হারাম ও কবিরা গোনাহ। জালিমের উপর আল্লাহর লা’নত ও অভিশাপ এবং জালিমের ঠিকানা জাহান্নাম। মজলুমের ফরিয়াদ সরাসরি আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায় এবং যেকোনো মুহূর্তে আল্লাহ জালিমের ওপর আযাব ও গযব নাজিল করতে পারেন।

কোরআন মজীদে একাধিক আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেছেন : তোমরা বাতিল উপায়ে একে অন্যের সম্পদ গ্রাস করো না। (সূরা বাকারা : ১৮৮; সূরা নিসা : ২)। বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণে নবী (সা.) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন : নিঃসন্দেহে তোমাদের জান, মাল, ইজ্জত-আব্রু তোমাদের পরস্পরের জন্য এমনভাবে সংরক্ষিত, যেমন হজের দিবসটি হজের মাস ও (হজের শহর) মক্কায় সংরক্ষিত। সুতরাং কারো জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুতে হস্তক্ষেপ করা হজের সম্মানিত মাসে, হজের সম্মানিত দিবসে হারাম শরীফের ওপর হামলার মতো অপরাধ। (সহীহ বুখারী : ১৭৩৯)।

নিঃসন্দেহে যৌতুক নেওয়া ‘আকল বিলবাতিল’ বা পরস্ব হরণের অন্তর্ভুক্ত। বিয়ে একটি পবিত্র বন্ধন। এটি ব্যবসা বা অর্থোপার্জনের উপায় নয়। তেমনি বর-কনেও ব্যবসার পণ্য নয়, যাদেরকে বিক্রি করে পয়সা কামানো হবে। যারা বিয়ের মতো পবিত্র কাজকে ‘সোর্স অফ ইনকাম’ বানায় তারা আল্লাহর বিধানের অবজ্ঞাকারী। কোরআন মজীদে আল্লাহতায়ালা যে ‘আকল বিল বাতিল’ কে হারাম করেছেন তার অর্থই হলো, এমন কোনো পন্থায় সম্পদ উপার্জন, যাকে আল্লাহ উপার্জনের মাধ্যম বানাননি। শরীয়তের দৃষ্টিতে এটি হজের মহিমান্বিত মাসের মহিমান্বিত দিবসে খানায়ে কাবার ওপর হামলা করার মতো অপরাধ।

কে না জানে, অন্যের সম্পদ লুট করা কবিরা গোনাহ! বড় কোনো সম্পদ নয়, যদি জোর করে কেউ কারো একটি ছড়িও নিয়ে যায় সেটাও গছব ও লুণ্ঠন, যা সম্পূর্ণ হারাম। লুণ্ঠিত বস্তু অনতিবিলম্বে ফিরিয়ে দেওয়া ফরয। হাদীস শরীফে ইয়াযীদ ইবনুস সায়েব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলে কারীম (সা.) বলেন : কেউ যেন তার ভাইয়ের জিনিস উঠিয়ে না নেয়; না ইচ্ছা করে, না ঠাট্টাচ্ছলে। একটি ছড়িও যদি কেউ তুলে নেয় তা যেন অবশ্যই ফিরিয়ে দেওয়া হয়। (মুসনাদে আহমদ : ১৭৯৪০)।

যৌতুক নেওয়া কারো সামান্য জিনিস তুলে নেওয়ার মতো বিষয় নয়; বরং তা সরাসরি লুণ্ঠন ও ডাকাতি। পার্থক্য শুধু এই যে, এখানে ছুরি-চাকুর বদলে বাক্যবান ও চাপের অস্ত্র প্রয়োগ করা হয়, যা মজলুমের মন-মানসে অনেক বড় ও গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। তো ডাকাতি ও লুটতরাজের যে গোনাহ যৌতুক নেওয়ার গোনাহও তার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন