ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি মঙ্গলবার দাবি করেন যে, উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণে তার সেনাবাহিনী রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ থেকে বিশাল এলাকা দখল করে নিয়েছে। ইউক্রেনের সরকার এখন খোলাখুলি বলছে যে, তাদের টার্গেট এখন দক্ষিণে ক্রিমিয়ার সীমান্তবর্তী খেরসন, মারিউপোল এবং সেই সাথে পূর্বের ডনবাস। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, শীতের আগে জাপোরোজিয়া পারমাণবিক কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়াও এখন ইউক্রেনের অন্যতম প্রধান সামরিক লক্ষ্য। কিন্তু সেটি কি করতে পারবে তারা?
এ ব্যাপারে অবশ্য অনেকেই সন্দিহান। এমনকি ইউক্রেন যে সাফল্য দাবি করছে তা যদি তারা পেয়েও থাকে তাহলেও এই সামরিক সাফল্যকে কতটা গুরুত্ব দেয়া উচিৎ, তা নিয়েও বিশ্লেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কারণ, খেরসনসহ দক্ষিণের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিশাল এলাকা এখনও রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। পূর্বের ডনবাস অঞ্চলের ৯০ শতাংশই তাদের দখলে। এমনকি পুনর্দখল করা উত্তর-পূর্বের খারকিভ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ স্থায়ীভাবে ধরে রাখাটাও ইউক্রেনের জন্য কতটা সহজ হবে, তা নিয়েও সন্দেহ প্রবল। কারণ এলাকাটি রাশিয়ার সীমান্তে এবং ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে রাশিয়া তাদের সীমান্তের ভেতর থেকেই দূরপাল্লার কামান দিয়ে সহজেই আঘাত করার ক্ষমতা রাখে।
রোববার খারকিভ শহরে দেশের বৃহত্তম থারমাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে ইউক্রেনের এই নিয়ন্ত্রণ কতটা ভঙ্গুর। বিবিসির প্রতিরক্ষা বিষয়ক সংবাদদাতা জনাথন বিল বলেন, রাশিয়া গত কয়েক মাসে আস্তে আস্তে পূর্ব থেকে সৈন্য সরিয়ে দক্ষিণে প্রতিরক্ষা জোরদার করেছে। তাছাড়া দক্ষিণের যে ভৌগলিক বাস্তবতা, তাতে প্রায় উন্মুক্ত প্রান্তরে রুশ সৈন্যদের সাথে ইউক্রেনীয়দের লড়তে হবে - যেটা তাদের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে।
‘যুদ্ধের প্রথম দিকে রুশ সৈন্যদের যে বিপদ পোহাতে হয়েছে, ঠিক একই হাল হতে পারে দক্ষিণে ইউক্রেনীয় সৈন্যদের। অনেকগুলো ফ্রন্ট এক সাথে খুললে তাদের বড় ঝুঁকির মুখে পড়তে হতে পারে ... যত ভেতরে তারা ঢুকবে সরবরাহ লাইন তত লম্বা হবে - যা রাশিয়ার টার্গেট হতে পরে। জায়গায় জায়গায় ইউক্রেনীয়রা ঘেরাও হয়ে পড়তে পারে।’ যুদ্ধে এলাকা দখল করা যতটা কঠিন, তা ধরে রাখা যে আরও কঠিন - উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে রুশ সৈন্যদের প্রত্যাহারের ঘটনা তার একটি নমুনা।
এছাড়া, ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখা রাশিয়ার কাছে এক নম্বর অগ্রাধিকার। খেরসন এবং মারিউপোলের মত জায়গার নিয়ন্ত্রণ তাই তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এই অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারলে রাশিয়ার মূল ভূখন্ডের সাথে ক্রাইমিয়ার স্থলপথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হবে। ফলে, বিশ্লেষকরা মনে করেন, দক্ষিণের নিয়ন্ত্রণ সংহত করতে রাশিয়া তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করবে।
তবে বিশাল একটি এলাকা পুনর্দখলের ঘটনায় এই মুহুর্তে রাজনৈতিক কিছু সুবিধা পেতে পারে ইউক্রেন। ‘তারা এখন বাকি বিশ্বের কাছে, বিশেষ করে পশ্চিমাদের কাছে ইঙ্গিত পাঠাচ্ছে যে তারা এই যুদ্ধে জিততে পারে এবং তাদেরকে অস্ত্র সাহায্য দেওয়া নিয়ে কারও ভেতর যেন আর কোন দ্বিধা না থাকে,’ বলেন বিবিসির জনাথন বিল। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সিনিয়র উপদেষ্টা আলেক্জান্ডার রোদনিয়ানস্কি সোমবার বিবিসিকে বলেন, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে এই সাফল্য অব্যাহত রাখার জন্য ইউরোপের সমর্থন অত্যন্ত জরুরি। আমরা আমাদের দেশ মুক্ত করছি, আমাদের অনেক সহযোগী মনে করেছিল এটা সম্ভব নয়।’
কিয়েভ কোন ‘নিরাপত্তা গ্যারান্টি’ পাবে না : কিয়েভ কোনো ‘নিরাপত্তা গ্যারান্টি’ পাবে না। কারণ বিশেষ করে এর খসড়াটি মূলত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি ‘প্রস্তাবনা’। রাশিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের উপপ্রধান দিমিত্রি মেদভেদেভ এ মন্তব্য করেছেন। কিয়েভের গোপন উপদেষ্টারা ‘নিরাপত্তা গ্যারান্টি’র একটি প্রকল্পের জন্ম দিয়েছে, যা মূলত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তাবনা। অবশ্যই, কেউ ইউক্রেনীয় নাৎসিদের কোন ‘গ্যারান্টি› প্রদান করবে না,’ মঙ্গলবার তিনি তার টেলিগ্রাম চ্যানেলে লিখেছেন।
তিনি বিশ্বাস করেন যে, কিয়েভের প্রস্তাবিত চুক্তিটি ‘ইউক্রেনে উত্তর আটলান্টিক চুক্তির অনুচ্ছেদ ৫ প্রয়োগ করার’ সমতুল্য। এই নিবন্ধটি ন্যাটোর প্রতিষ্ঠা চুক্তির একটি মূল নীতি হিসাবে যৌথ প্রতিরক্ষাকে নির্দেশ করে। সম্মিলিত প্রতিরক্ষার অর্থ হল জোটের একজন সদস্যের উপর আক্রমণ সমস্ত সদস্যদের উপর আক্রমণ হিসাবে বিবেচিত হবে। মেদভেদেভ সতর্ক করে দিয়ে বলেন, কিয়েভের খসড়া নিরাপত্তা প্রস্তাব সরাসরি রাশিয়ার সাথে ন্যাটোর হাইব্রিড যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত। যদি তারা কিয়েভ শাসনের কাছে সবচেয়ে বিপজ্জনক ধরনের অস্ত্র ব্যাপকভাবে দিতে থাকে, তাহলে শীঘ্র বা পরে সামরিক অভিযান অন্য মাত্রা অর্জন করবে।’
যৌথ বাহিনী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে : চেচনিয়ার নিরাপত্তা পরিষদের সেক্রেটারি, ‘আখমত’ বিশেষ অপারেশন ইউনিটের কমান্ডার আপটি আলাউদিনভ সোলেদারের কাছে বড় শক্তিবৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি যোগ করেছেন যে, সশস্ত্র বাহিনীর অভিযান স্থিতিশীল হয়েছে। ‘ফ্রন্ট ইতিমধ্যে স্থিতিশীল হয়েছে। আমাদের সোলেদার লাইনে এত যোদ্ধা কখনও ছিল না, এমনকি আমি একটি খুব বড় শক্তিবৃদ্ধি পেয়েছি। অর্থাৎ, আমরা বিশাল বাহিনী নিয়োজিত করেছি, যারা ইতিমধ্যে তাদের কাজ শুরু করেছে,’ তিনি মঙ্গলবার রাশিয়ান টিভিতে বলেছেন।
রাশিয়ান বাহিনী পুনরায় সংগঠিত হওয়ার সময় বালাক্লিয়া এবং কুপিয়ানস্কের নিকটবর্তী অঞ্চলগুলি হারিয়েছে, শীঘ্রই ফিরিয়ে নেয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে, তিনি যোগ করেছেন। ‘এগুলি শত্রুর সাথে যোগাযোগের লাইনে সাধারণ শহর এবং বসতি। আমাদের এই বসতিগুলি ফিরিয়ে নেওয়া খুব অল্প সময়ের ব্যাপার মাত্র,’ আলাউদিনভ বলেছেন।
আলাউদিনভের মতে, শত্রু বাহিনীর বেশিরভাগ সেনা যোগাযোগ লাইনে কেন্দ্রীভূত: প্রায় ৩০ থেকে ৪০ হাজার মানুষ। ‘এই বাহিনীগুলিকে যতটা সম্ভব ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন, যাতে আমরা গুরুতর হতাহতের শিকার না হই,’ আলাউদিনভ বলেন, ‘তাদেরকে পরে অবরুদ্ধ করা হবে।’ সূত্র : তাস, বিবিসি নিউজ, আল-জাজিরা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন