বছরের শুরু থেকেই লাগামহীনভাবে মার্কিন ডলারের চাহিদা বেড়ে চলার কারণে অব্যাহতভাবে কমছে টাকার মান। এরই প্রেক্ষাপটে বাজারে সব নিত্যপণ্যের মূল্যও লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে। করোনাকালীন বাস্তবতায় কোটি কোটি মানুষের আয় কমে গেলেও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির সাথে সাথে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে দেশের সাধরণ মানুষ। আমদানি ব্যয় কমিয়ে, সর্বক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রতা সাধনের পাশাপাশি চলমান অনেক প্রকল্পের অর্থছাড় বন্ধ করেও ডলারের চাহিদা ও মূল্যবৃদ্ধির রাশ টানা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক একেক সময় একেক ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েও টাকার মূল্য পতন ঠেকাতে পারছে না। এ সপ্তাহে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা মেনে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য অভিন্ন মুদ্রা বিনিময় হার ঘোষণা করলেও তাদের লক্ষ্য এরই মধ্যে ব্যর্থ হয়ে গেছে। গত ১২ সেপ্টেম্বর এবিবি ও বাফেদা ডলারের অভিন্ন মূল্য ঘোষণার পর সব প্রতিষ্ঠান তাৎক্ষণিকভাবে তা পালন করার কথা থাকলেও অধিকাংশ ব্যাংকই তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। গত বুধবার একদিনে ডলারের বিপরীতে টাকার সর্বোচ্চ দরপতন ঘটেছে। এর ফলে দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে ‘অদ্ভুত ও উদ্ভট’ বলছেন অর্থনীতিবিদরা। এ থেকে উত্তরণের কোনো পথই যেন খুঁজে পাচ্ছে না দেশের মুদ্রা নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলো।
ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির সাথে সাথে সব পণ্যের মূল্য বেড়ে চলেছে। মানুষের আয়-ব্যয়ের সীমারেখা সঙ্গতিহীন হয়ে পড়ার কারণে সমাজে গভীর সংকট দেখা দিতে শুরু করেছে। সীমিত ও স্বল্প আয়ের মানুষ নিত্যপণ্যের মূল্য মিটিয়ে জীবন ধারণের তাগিদে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদাগুলো অগ্রাহ্য করতে বাধ্য হওয়ায় তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ড্রপআউট বা শিক্ষার্থী ঝরে পড়া বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে যে কোনো সমাজের অর্থনীতি ও জীবনমান উন্নয়নের অন্যতম মৌলিক সূচক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। চলমান মূল্যস্ফীতি ও টাকার মূল্য পতনের ধারাবাহিক প্রবণতা আমাদের সামগ্রিক সামাজিক-অর্থনৈতিক অর্জনগুলোকে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সরকারের নানামাত্রিক ব্যবস্থা এবং ব্যাংক ও মুদ্রা বিনিময় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার পরও একদিনের ব্যবধানে প্রতি ডলারে ১০ টাকা ১৫ পয়সা দরপতনের মধ্য দিয়ে যে অশনিসংকেত পাওয়া যাচ্ছে তা রোধের কার্যকর পন্থা খুঁজে বের করতে না পারলে দেশে বড় ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকট ও অস্থিতিশীলতা অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকাÐে স্বেচ্ছাচারিতা, অস্বচ্ছতা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অমান্যের প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও বিভিন্ন সময়ে নির্দেশনা দিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। নির্দেশনা বাস্তবায়নে যথাযথ নজরদারি বা অমান্যকারীদের জবাবদিহির আওতায় আনার ব্যর্থতা অস্বীকার করা যায় না।
বাফেদা ও এবিবি’র অভিন্ন মুদ্রা বিনিময় হার এবং রেমিটেন্স ও রফতানির দরে বড় ব্যবধানের কারণে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা ও বৈষম্য বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটা স্বাভাবিক। কিন্তু মানুষের আয় না বাড়লে বাজারের চাহিদা কমে গিয়ে নতুন সংকট সৃষ্টি করতে পারে বলে বাজার ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। জ্বালানি থেকে শুরু করে নিত্যপণ্যের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির সংকটে দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিতে জরুরি উদ্যোগ প্রয়োজন। ভুয়া এলসি খোলা, ওভার ইনভয়েসিংসহ দেশ থেকে অর্থ পাচারের পন্থাগুলোর উপর যথাযথ নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এ অবস্থার উত্তরণ আদৌ সম্ভব নয়। আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বৈদেশিক বাণিজ্যে অস্বচ্ছতা ও উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি-অপচয় বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ অবস্থায় দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতা অর্থনৈতিক সংকট বাড়িয়ে তুলতে পারে। দেশে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পাশাপাশি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়নে দেশের সব রাজনৈতিক পক্ষকে একটি সমঝোতামূলক অবস্থানে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিতে হবে। মূল্যস্ফীতির কারণে দরিদ্র ও কর্মহীন মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে বিশেষ অর্থনৈতিক সহায়তা কর্মসূচি চালুর উদ্যোগ নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন