দায়িত্বশীল বাবা-মা মাত্রই সন্তানকে নিয়ে চিন্তা করেন। সন্তানের জন্যে দায়িত্বশীল পিতা-মাতার এই চিন্তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকেও বিষয়টি নন্দিত। কেবল নন্দিত নয় শরয়ী দৃষ্টিকোণ থেকে সন্তানের সুন্দর জীবন গড়ার লক্ষ্যে চিন্তা-ভাবনা ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ পিতা-মাতার অনিবার্য দায়িত্ব। মুসলিম সন্তানের জীবনের বিভাগ দু’টি : দ্বীনি জীবন ও পার্থিব জীবন। পার্থিব জীবন নিয়ে চিন্তা তো প্রায় সবাই করে থাকে। কিন্তু দ্বীনি জীবনের ক্ষেত্রে অনেকের মাঝে অবহেলা লক্ষ্য করা যায়।
সন্তানের দ্বীনি ও দুনিয়াবি উভয় জীবন সুন্দর করার লক্ষ্যে পিতা-মাতার কী কী দায়িত্ব ও করণীয় তা দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। সংক্ষিপ্ত এই প্রবন্ধে যার সুযোগ নেই। কিন্তু এটুকু কথা এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে সঠিক উৎস থেকে জ্ঞানলাভ অতঃপর যথাযথ চর্চা-অনুশীলন ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে তার সঠিক প্রয়োগ খুবই জরুরি। গুরুত্ব ও তাৎপর্য উপলব্ধির অভাবে মানুষ যে বড় বড় বিষয়গুলোতে অবহেলার শিকার হয় এই বিষয়টি তার অন্যতম।
সন্তানের সুন্দর জীবন গড়ার লক্ষ্যে পিতা-মাতার করণীয় একটি বিষয়ে হেদায়াত আছে কোরআন মজিদের সূরা কাহফে। সেই হেদায়াত নিয়েই আজকের আলোচনা। কোরআন মজিদ আমাদের একজন ‘মহান পিতা’র সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। যিনি নিজ সন্তানদের দেখাশোনা করার তেমন সুযোগ পাননি। কারণ তার সন্তনরা বড় হওয়ার আগেই তাকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। তিনি যখন এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যান, তখন তারা অপ্রাপ্তবয়স্ক। স্বাভাবিকভাবেই তার পক্ষে সন্তানদের বেশি দূর এগিয়ে দিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু তিনি এমন এক কীর্তির অধিকারী ছিলেন যা সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য জামিন হয়ে যায়।
কোরআন মজিদে খাযির (আ.) এর সঙ্গে মুসা (সা.) এর সফরের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। সেই ঘটনায় আছে, চলতে চলতে একসময় খাযির আলাইহিস সালাম ও মুসা আলাইহিস সালামের প্রচণ্ড খিদে পেয়ে যায়। তাই এক জনপদে পৌঁছে তারা সেই জনপদবাসীকে মেহমানদারির অনুরোধ করেন। কিন্তু তারা মেহমানদারি করতে অস্বীকৃতি জানায়। এমন ক্ষুধার্ত দু’জন লোককে খাবার দিতে অস্বীকৃতি জানানো ছিল অমানবিকতা।
তারা সামনে চলতে থাকেন। পথিমধ্যে দেখতে পান, জনপদের একটি প্রাচীর ভেঙে পড়ছে। খাযির আলাইহিস সালাম প্রাচীরটি ঠিকঠাক করে দেন। জনপদবাসীর অমানবিক আচরণের কারণে মুসা আলাইহিস সালাম একটু রুষ্ট ছিলেন, বিনা তলবে প্রাচীর ঠিক করতে দেখে তিনি বললেন, আপনি চাইলে প্রাচীর ঠিক করার বদলে এদের কাছ থেকে পারিশ্রমিক নিতে পারতেন। অর্থাৎ এরা তো এমনিতে ভদ্র ও মানবিক নয়। ক্ষুধার্ত মানুষকেও খাবার দিতে রাজি হয় না। তাই পারিশ্রমিক বাবদ এদের কাছ থেকে কিছু নেওয়া যেত।
খাযির (আ.) তখন মুসা (সা.) কে জানালেন, এই প্রাচীর জনপদবাসীর কল্যাণে ঠিক করা হয়নি। তা করা হয়েছে দুই এতিম বালকের জন্য! তিনি তা নিজের মর্জিতেও করেননি। আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁকে এই প্রাচীর ঠিক করার আদেশ করেছেন! দুই এতিম বালক কোত্থেকে এল? এই প্রাচীর ঠিক করার সাথে তাদের কী সম্পর্ক? কেন আল্লাহতায়ালা তাঁকে এই প্রাচীর ঠিক করার নির্দেশ দিলেন? এই সব প্রশ্নের জবাব শুনুন খাযির (আ.) এর জবানিতে : আর প্রাচীরটি ছিল এই শহরে বসবাসকারী দুই এতিম বালকের। এর নিচে তাদের গুপ্তধন ছিল। আর তাদের পিতা ছিল নেক লোক। সুতরাং আপনার প্রতিপালক চেয়েছেন, ছেলে দু’টো যেন প্রাপ্তবয়সে উপনীত হয় এবং তাদের গুপ্তধন বের করে নিতে পারে। (সূরা কাহফ : ৮২)।
প্রাপ্তবয়সে পৌঁছার আগে প্রাচীর ভেঙে পড়লে অন্যরা গুপ্তধন নিয়ে যাবে। তাই আল্লাহতায়ালা খাযির (আ.) কে প্রাচীর ঠিক করে দেওয়ার নির্দেশ দেন। সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বালকদ্বয়ের পিতা ধনসম্পদ তো সঞ্চয় করেছিলেন; কিন্তু সন্তানদের প্রতিপালন করার সুযোগ তিনি পাননি। তাদের হাতে সম্পদ বুঝিয়েও দিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু তার মাঝে একটি বিশেষ গুণ ছিল। ব্যক্তি জীবনে তিনি নেককার ছিলেন। তাই তাঁর অবর্তমানে খোদ আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁর সন্তানদের সম্পদের যিম্মাদারি নিয়েছেন, হেফাযতের ব্যবস্থা করেছেন।
এ ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা পাই, সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যত বিনির্মাণে অন্যতম করণীয় হলো, খোদ বাবা-মা নেককার হওয়া। পিতা-মাতা সত্যিকারার্থে নেককার হলে তাদের অবর্তমানেও আল্লাহতায়ালা সন্তান-সন্ততির দেখভালের ব্যবস্থা করে দিতে পারেন।
এ ঘটনা থেকে আমরা এও বুঝতে পারি, আগত প্রজন্মের জন্য যথাযথ নিয়ম মেনে সম্পদ সঞ্চয় করা জায়েয। কিন্তু পার্থিব সম্পদ আগত প্রজন্মের জন্য আসল সম্পদ নয়। আসল সম্পদ হল, নেককাজ। নেককাজ এমন এক ধন, যার সুফল শুধু নেককারগণই ভোগ করেন না, বরং পরবর্তী প্রজন্ম পর্যন্ত এর সুফল ভোগ করে। এমনকি কখনো তা পরবতী প্রজন্মের পার্থিব ধনসম্পদের সুরক্ষা পর্যন্ত নিশ্চিত করে। আল্লাহ আমাদের তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণের তৌফিক দিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন