বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম

যে কটুকথা শুনেও সবর করে-২

মাওলানা মুহাম্মাদ যাকারিয়া আব্দুল্লাহ | প্রকাশের সময় : ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

নবী কারীম (সা.)-এর বৈশিষ্ট্য এমন ছিল যে, তিনি মানুষের কটূক্তি সহ্য করেছেন। এই মর্মে হাদীসে একটি ঘটনার অংশবিশেষ উল্লেখ করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা নবী কারীম (সা.) কিছু জিনিস বণ্টন করলেন, যেমন বিভিন্ন সময় তিনি বণ্টন করতেন। অর্থাৎ গনীমতের সম্পদ বণ্টন করলেন। (এটা হুনাইন যুদ্ধের ঘটনা)

তখন আনসারীদের এক লোক বলল : আল্লাহর কসম, এটা এমন বণ্টন, যে বণ্টনে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি উদ্দেশ্য ছিল না। বিষয়টি হল, হুনাইন যুদ্ধে রাসূলে কারীম (সা.) আরবের কিছু বিশেষ ব্যক্তিকে গনীমত থেকে বিশেষ অংশ দিয়েছিলেন। তাদেরকে বেশি অংশ দেয়ার উদ্দেশ্য ছিল, তাদেরকে ইসলামের প্রতি আকর্ষণ করা। ইসলামের ব্যাপারে তাদের মনকে কোমল করা। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় বিষয়টি পরিষ্কার আছে। রাসূলে কারীম (সা.) ইরশাদ করেছেন : ‘তাদেরকে আমি বেশি দিচ্ছি- ইসলাম ও মুসলমানের প্রতি তাদের প্রীতি ও কোমলতা আকর্ষণ করার জন্য।’

আমি তখন বললাম, অবশ্যই আমি এই কথাটি নবী (সা.)-কে জানিয়ে দিব। আমি তাঁর কাছে এলাম। তিনি তাঁর সঙ্গীদের মাঝে ছিলেন। আমি চুপে চুপে তাঁর কাছে গিয়ে বিষয়টি জানালাম। কথাটি তাঁর জন্য কষ্টদায়ক হলো এবং কষ্টের ভাব চেহারায় ফুটে ওঠল।

আমার তখন মনে হলো, আহা, আমি যদি তাঁকে এই সংবাদটি না দিতাম! এরপর রাসূলে কারীম (সা.) বললেন- মূসা (আ.)-কে এর চেয়ে বেশি কিছু দ্বারা কষ্ট দেওয়া হয়েছে। তিনি সবর করেছেন। এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, রাসূলে কারীম (সা.)-এর সীরাতের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, উম্মতের কোনো কোনো ব্যক্তি থেকে তিনি কখনো কখনো কষ্ট পেয়েছেন, তারপরও সবর করেছেন।

এ ঘটনায় আরো লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, কারো কারো মনে যে প্রশ্ন জেগেছিল নবী (সা.) তার নিরসনও করেছেন। সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমসহ হাদীসের কিতাবগুলোতে এ ঘটনা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। তাতে আছে যে, আল্লাহর রাসূল (সা.)-কে বিষয়টি জানানো হলে তিনি আনসারীদের এক জায়গায় একত্র করে এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তারা বললেন, ‘আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে যারা ‘ফকীহ’ (অর্থাৎ যাদের দ্বীনের প্রজ্ঞা আছে) তারা তো কিছু বলেননি, তবে অন্যরা বলেছে।’

বর্ণনাকারী বলেন, সাহাবীগণ কখনো মিথ্যার আশ্রয় নিতেন না। বাস্তব অবস্থা অকপটে তুলে ধরতেন। আল্লাহর রাসূল (সা.) বললেন : হে আনসারী সম্প্রদায়! তোমরা কি পথহারা ছিলে না, এরপর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদের পথ দেখালেন? তোমরা কি বিবাদ-বিভক্তিতে জর্জরিত ছিলে না, এরপর আল্লাহ আমার দ্বারা তোমাদের ঐক্যবদ্ধ করলেন? তোমরা কি নিঃস্ব ছিলে না, এরপর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদের নিঃস্বতা দূর করলেন?’ আল্লাহর রাসূল যখন এ কথাগুলো বলছিলেন তখন প্রতিউত্তরে আনসারী সাহাবীগণের জবাব ছিল : আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই (আমাদের প্রতি) অধিক অনুগ্রহকারী।’

(এখানে আল্লাহর রাসূল সবার আগে হেদায়েতের নিআমত, এরপর ঐক্যবদ্ধতার নিআমত, এরপর সচ্ছলতার নিআমত উল্লেখ করেছেন) এরপর আল্লাহর রাসূল বললেন : তোমরাও তো আল্লাহর রাসূল (সা.)-কে প্রত্ত্যুত্তরে কিছু বলতে পার। তা বলছ না কেন?’ তোমরা তো বলতে পার- যদি বল তবে তা সত্যই হবে এবং তোমাদের সত্যবাদীই বলা হবে- আপনি তো আমাদের কাছে ওই সময় এসেছেন, যখন অন্যরা আপনাকে মিথ্যাবাদী বলেছে। তখন আমরা আপনাকে সত্যবাদী বলেছি।

আপনি ওই সময় এসেছেন, যখন আপনার কোনো সাহায্যকারী ছিল না। তখন আমরা আপনার নুসরত করেছি। আপনি এমন অবস্থায় এসেছেন, আপনাকে আশ্রয়হীন করা হয়েছে। ওই সময় আমরা আপনাকে আশ্রয় দিয়েছি। আপনি এমন অবস্থায় এসেছেন, আপনি ছিলেন রিক্তহস্ত, ওই সময় আমরা আপনার সহমর্মী হয়েছি।’ সুবহানাল্লাহ! কীভাবে মানব-মনের এক একটি কাঁটা বের করে আনছেন এবং হৃদয়কে কণ্টকমুক্ত করছেন! আল্লাহর রাসূলের এই কথাগুলোর জবাবে আনসারীদের জবাব কী ছিল? তাঁদের জবাব ছিল : বরং আমরাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি কৃতার্থ। (সহীহ বুখারী : ৪৩৩০ (ফাতহুল বারী)।

অর্থাৎ তারা তো প্রজ্ঞাবান ছিলেন। তাদের কারো কারো সাময়িক বিস্মৃতি ঘটলেও তাঁদের চেয়ে এ উপলব্ধি আর কাদের বেশি হতে পারে যে, আল্লাহর রাসূল (সা.) এর প্রকৃত নুসরতকারী স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। তিনি যাদেরকে নিজ নুসরতের কাজে ব্যবহার করেছেন, এ তো তাদের পরম সৌভাগ্য। আল্লাহ তাআলা তো কোনোরূপ মাধ্যম ছাড়াও তাঁর দ্বীনের নুসরত করতে পারেন। আবার যাদেরকে মাধ্যম বানিয়েছেন তারা ছাড়া অন্যদেরকেও মাধ্যম বানাতে পারেন। সুতরাং তাদের অনুসরণীয় ও অবিস্মরণীয় জবাব : ‘বরং আমরাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি কৃতার্থ।’ এই হচ্ছে দ্বীনের সমঝ, নুসরতে দ্বীন সম্পর্ক সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি।

তো নবী (সা.) যেমন কারো কারো কটূক্তির ওপর সবর করেছেন তেমনি প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জানিয়ে সকলকে ঐক্যবদ্ধও রেখেছেন। আমাদের সমষ্টিগত জীবনেও এরকম অনেক প্রসঙ্গ সামনে আসে। অনেক কটুকথা, অবাস্তব কথা শুনতে হয়। ওসব ক্ষেত্রে উচিত হলো, রাসূলুল্লাহর সীরাতের অনুসরণ করা। আর আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যে গুণ, বান্দা হিসেবে যদ্দুর সম্ভব নিজের মধ্যে তা অর্জন করার চেষ্টা করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে বোঝার এবং আমল করার তাওফীক দান করুন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (4)
মোঃ বাতেনুর রহমান ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৬:১২ এএম says : 0
আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহ তুমি আমাকে ঈমানের সাথে সহজ মৃত্যু দিও।
Total Reply(0)
Rabbul Islam Khan ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৬:১২ এএম says : 0
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ করার মাধ্যমে দুনিয়া ও পরকালের সব নেয়ামত ও সন্তুষ্টি অর্জনের তাওফিক দান করুন। কুরআন-সুন্নাহর উপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
Total Reply(0)
Md Ali Azgor ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৬:১৩ এএম says : 0
সবর করার সময় কোনাভাবেই ক্ষোভ, হতাশা ও অস্থিরতা প্রকাশ করা যাবে না। নিজের ভাষা ও আচরণকে সংযত রাখাও জরুরি।
Total Reply(0)
Antara Afrin ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৬:১৩ এএম says : 0
জীবনে বিপদ-মুসিবত নেমে এলে অস্থিরতা প্রকাশ না করে ধৈর্যধারণ করাই উত্তম। আর তাতে আল্লাহর কাছে পাওয়া যাবে অনেক প্রতিদান।
Total Reply(0)

এ সংক্রান্ত আরও খবর

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন