ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে আবারও এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। ২০১৯ সালে বাতিল হওয়া প্রস্তাবটি পুনর্বিবেচনার জন্য পাঠানো হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ বলছে, অর্থনৈতিক কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ায় সড়ক-মহাসড়কে গাড়ির চাপ বেড়েছে। বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উপর চাপ বেড়ে গেছে বহুগুণ। বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫০ শতাংশই রাজধানী ঢাকা ও বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক কর্মকাÐকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। দেশের প্রধান এ দুই নগরীকে যুক্ত করেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। বৈদেশিক বাণিজ্যের ৯০ শতাংশ এ মহাসড়কের ওপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বৃদ্ধি, বাজার স¤প্রসারণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে মহাসড়কটি চারলেনে উন্নত করা হয়। মহাসড়কটিতে বর্তমানে ধারণক্ষমতার থেকে বেশি যানবাহন যাতায়াত করায় নতুন করে এই মহাসড়কটি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করার পরিকল্পনা করে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে এক্সপ্রেসওয়ে খুবই জরুরি। বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম অনেক দ্রæত বাড়ছে। ফলে মহাসড়কটির সক্ষমতা কমেছে।
জানা গেছে, পিপিপির মাধ্যমে বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পের রেজিস্ট্রেশন অব ইন্টারেস্ট আহŸান এবং ভিজিএফ চ‚ড়ান্তকরণও হয়। এর কিছুদিন পর যখন নির্মাণপ্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা, তখনই প্রকল্পটি বাতিলের ঘোষণা আসে। অথচ এসব কাজে সময় গেছে ৮ বছর, ব্যয় হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। এরপর সিদ্ধান্ত আসে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বুলেট ট্রেন চালুর। বর্তমানে এ পথে যাতায়াতে অন্তত ছয় ঘণ্টা সময় লাগে। হাইস্পিড তথা বুলেট ট্রেন চালু হলে সময় লাগবে ৫৫ মিনিট। দ্রæতগতির এই ট্রেন চালু করতে খরচ পড়বে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা। বিপুল অঙ্কের এই অর্থ খরচ করে রেলওয়ের জন্য এই প্রকল্প কতটি বাস্তবসম্মত হবে, এমন প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। এরই মধ্যে সরকারের ১১০ কোটি ১৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে হাইস্পিড ট্রেনের সমীক্ষা ও বিশদ ডিজাইনে।
এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের যোগাযোগে এক্সপ্রেসওয়ে জরুরি। উদ্যোগটি বাতিল করা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। হাইস্পিড ট্রেনের সিদ্ধান্ত ভুল, তা বুঝতে সমীক্ষার দরকার নেই। এখন চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার এক্সপ্রেসওয়ে করার কথা বলা হচ্ছে। এটিও দরকারি। পর্যটন, এনার্জি হাব থেকে শুরু করে নানা কারণে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তার আগে তো রাজধানী ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামে এক্সপ্রেসওয়েটি করা দরকার। বরং ঢাকা-মাওয়ার আগেই চট্টগ্রাম রুটে এক্সপ্রেসওয়ে করা উচিত ছিল। এখন এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের সুযোগ পর্যাপ্ত আছে কি? ওই মহাসড়ক ধরে অবকাঠামো নিশ্চয়ই গড়ে উঠেছে। নতুন করে জমি অধিগ্রহণেও খরচ বাড়বে। অথচ তখনই প্রকল্পটির কাজ শুরু করে দেওয়া উচিত ছিল।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিনউল্লাহ নুরীর সভাপতিত্বে ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত বৈঠক হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের লক্ষ্যে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও নকশা প্রণয়নের কাজ শেষ। মূল বিনিয়োগ প্রকল্প অর্থাৎ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সমান্তরালে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কার্যক্রম বন্ধ হয়েছে ২০১৯ সালের ২৮ অক্টোবর। রেলের মাধ্যমে হাইস্পিড ট্রেন চালু করা হবে, তাই সওজের আওতাধীন এক্সপ্রেসওয়ে বাতিলের নির্দেশনা আসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। এখন রেলের প্রস্তাব অনিশ্চতায়। তাই বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ করিডরের পুরো অ্যালাইনমেন্টের ওপর স্টাডি করা হবে।
কোন সেগমেন্টে সড়কের রাইট অব ওয়ে’র আওতাধীন জমির পরিমাণ কত রয়েছে, এর অবস্থান এবং বিদ্যমান সড়কের উভয়পাশের বর্তমান অবস্থার তথ্য সংগ্রহ করতে সওজকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বর্তমান এবং ভবিষ্যতের চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন তৈরি করতে বলা হয়েছে। সেখানে সংক্ষিপ্ত এবং দীর্ঘমেয়াদে কী করা যায়, তার ধারণাপত্র দিতে বলেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সচিব এবিএম আমিনউল্লাহ নুরি বলেন, আগে প্রস্তাবটি একবার বাতিল করা হয়েছিল। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সময়ের গুরুত্ব বিবেচনায় পর্যালোচনা করা হয়েছে। আরও কিছু কাজ বাকি আছে। এরপর পুনর্বিবেচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবার পাঠানো হবে।
এদিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ২০১৪ সালের ১৫ জুন সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে পরামর্শক নিয়োগের অনুমোদন মেলে। ওই বছরের ১৪ জুলাই সওজের সঙ্গে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের চুক্তি হয়। ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর উড়ালপথ ও সমতল সমন্বয়ে নকশা (ডিজাইন) জমা দেয় সওজে। ঢাকা-কুমিল্লা ৮৪ কিলোমিটার, কুমিল্লা-ফেনী ৫২ দশমিক ৮০ কিলোমিটার এবং ফেনী-চট্টগ্রাম ৮০.৯৫ কিলোমিটার তিনটি প্যাকেজে বিভক্ত করার সুপারিশ করে ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার। এরপর ২০১৭ সালের ২০ এপ্রিল পিইসি সভার সুপারিশ অনুযায়ী ডিপিপি পুনর্গঠন করা হয়। সওজের পক্ষ থেকে নির্মাণের সময়কাল ধরা হয় ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল। সেই হিসাবে তখন কাজ শুরু করলে চলতি বছরে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এরই মধ্যে ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর সেতু বিভাগের মাধ্যমে পৃথকভাবে প্রকল্প হাতে নিয়ে এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট আহŸান করা হয়। এ নিয়ে সওজ ও সেতু কর্তৃপক্ষের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। পরে সওজের মাধ্যমেই বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত আসে। এরপর ২০১৮ সালের ১৫ মে অর্থ বিভাগ কর্তৃক প্রকল্পের ভিজিএফ (প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৩০ শতাংশ) প্রদানের নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়। এরপর পিপিপি কর্তৃপক্ষ এডিবি ও বুয়েটকে ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার হিসাবে নিয়োগ দেয় সওজ। ২০১৯ সালের ৬ ফেব্রæয়ারি প্রথম প্যাকেজের (ঢাকা-কুমিল্লা) অংশের জন্য রেজিস্ট্রেশন অব ইন্টারেস্ট আহŸান করা হয়। ওই প্রস্তাবে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ দেখা দেয়। কিন্তু ওই বছরের অক্টোবরে প্রকল্পের কার্যক্রম বাতিলের সিদ্ধান্ত আসে। পরে বিদ্যমান চার লেনের সঙ্গে আরও চার লেন এবং মহাসড়কের উভয় পাশে সার্ভিস লেন নির্মাণের প্রস্তাব পাঠায় সওজ। সেই হিসাবে একটি পৃথক প্রকল্পের কাজে পরামর্শক নিয়োগের কারিগরি মূল্যায়ন প্রক্রিয়াধীন।
সূত্রমতে, এক্সপ্রেসওয়ে ও হাইস্পিড ট্রেনের তুলনামূলক একটি বিবরণী প্রস্তুুত করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। সেখানে বলা হয়, অ্যাটগ্রেড ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ২১৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে জন্য জমি লাগবে ৮০০ হেক্টর। খরচ পড়বে ৩৬০ কোটি ডলার। আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য ২১৭ কিলোমিটারে জমি লাগবে ৪৫০ হেক্টর। ব্যয় হবে ৮৮০ কোটি ডলার। অন্যদিকে, হাইস্পিড ট্রেনের জন্য ২৪০ কিলোমিটার দূরত্বের জন্য ৬০০ হেক্টর জমি লাগবে। নির্মাণ ব্যয় হবে ১৪৮০ কোটি ডলার। এখন অ্যাট-গ্রেড ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করতে চাইলে শুধু পরামর্শক নিয়োগ করে আগের স্টাডি রিপোর্ট আপডেট করলেই হবে। এই এক্সপ্রেসওয়ে যাত্রী ও পণ্য, উভয়ের ব্যবহার উপযোগী। চট্টগ্রাম ও মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রফতানি কাজে এটি সহায়ক হবে। অন্যদিকে হাইস্পিড ট্রেন মূলত যাত্রী পরিবহনের জন্য। এছাড়া ২০২৪ সালের মধ্যে এ মহাসড়কে চলাচলকারী যানবাহনের সংখ্যা বিদ্যমান চার লেনের ধারণ ক্ষমতার বাইরে যাবে। সে জন্য দ্রæত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি বলে মনে করছে সওজ।
পোশাক প্রস্তুুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর আমাদের একমাত্র বন্দর, সেটা আমাদের আমদানি ও রফতানির জন্য ব্যবহার করা হয়। চট্টগ্রামের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের যোগাযোগ ব্যবস্থাটি ছয় বা আট লেনের করা উচিত ছিল। সেটা করা হয়নি, যা প্রধানমন্ত্রীর ভিশনের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি। চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা দিন দিন বাড়ছে। এতে বাড়তি চাপ সামলাতে যোগাযোগের জন্য সরকারকে এখনই নজর দিতে হবে। দ্রæততার সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে গতি রেখে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করার কথা বলেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন