পাইলিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে, কিন্তু রাস্তার গর্ত ভরাট হয়নি। তাতে সড়ক যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সড়কজুড়ে বড় বড় গর্ত, কাদাপানিতে ডোবার আকার নিয়েছে। ভারী যানবাহনের চাকায় কাদাপানির ঢেউ উপচে পড়ছে আশপাশের দোকানপাট, বাসাবাড়িতে। গর্তে আটকা পড়ছে ভারী যানবাহনের চাকা। গাড়ি উল্টে সড়কে বন্ধ হচ্ছে যান চলাচল। রাতে-দিনে তীব্র যানজটে অতিষ্ট এলাকার মানুষ।
এমন চিত্র চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রধান সড়কের ইপিজেড থেকে বন্দরটিলা হয়ে সিমেন্ট ক্রসিং পর্যন্ত সড়কে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ধীরগতির কারণে এমন বেহাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নগরীর ইপিজেড থেকে সিমেন্ট ক্রসিং হয়ে নিমতলা বিশ^রোড, ফকিরহাট, বারিক বিল্ডিং পর্যন্ত এলাকার অবস্থাও একই রকম। কাজ চলছে সম্ভুক গতিতে। পতেঙ্গা সৈকত থেকে বন্দরটিলা পর্যন্ত পাইলিং শেষ হলেও সড়কের গর্ত ভরাট করা হয়নি।
ওয়াসার পাইপলাইন ও পিডিবি বিদ্যুতের লাইন সরিয়ে না নেয়ায় কাস্টম হাউস মোড় থেকে ফকিরহাট পর্যন্ত অংশে পাইলিংয়ের কাজও চলছে ধীরগতিতে। বারিক বিল্ডিং থেকে আগ্রাবাদ হয়ে দেওয়ানহাট পর্যন্ত পাইলিং শেষ কিন্তু গার্ডার বসানো হয়নি। লালখান বাজার অংশে পাইলিং শুরু হলেও দেওয়ানহাট থেকে টাইগারপাস পর্যন্ত চলছে ভবন ভাঙার কাজ।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএর সাথে পিডিবি, ওয়াসা, রেলওয়ে, সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থার সাথে সমন্বয়ের অভাবে সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক এ মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন এখন লেজেগোবড়ে অবস্থা। বন্দরনগরীর প্রধান এ সড়কটির এমন বেহাল অবস্থায় যানজট এখন স্থায়ী রূপ নিয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে তীব্র যানজট সকাল থেকে গভীর রাত অবধি অব্যাহত থাকছে। তাতে জনজীবনে সীমাহীন দুর্ভোগের পাশাপাশি আমদানি-রফতানি কার্যক্রম মারাত্মক বিঘ্নিত হচ্ছে। স্থবির হয়ে পড়েছে সড়কের দুইপাশের ব্যবসা-বাণিজ্য।
কয়েক দফা নকশা বদল করা হয়েছে। বন্দরসহ বিভিন্ন সংস্থার বাধার মুখে কাজও বন্ধ করতে হয়েছে। এর ফলে প্রকল্পে ব্যয় এবং সময় দুটোই বাড়ছে। গত মঙ্গলবার একনেকের সভায় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের খরচ এক হাজার ৪৮ কোটি টাকা এবং সময় আরো দুই বছর বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এতে তিন হাজার ২৫০ কোটি টাকার প্রকল্প ব্যয় চার হাজার ২৯৮ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। বাড়তি ব্যয় অনুমোদন পাওয়ায় প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে আর কোনো বাধা নেই বলে দাবি করছে। তবে কাজের যে গতি তাতে বর্ধিত সময় আগামী ২০২৪ সালের জুন নাগাদ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
নগরীর যান চলাচলে গতিসহ নানা লক্ষ্য সামনে নিয়ে সাড়ে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে। বিগত ২০১৭ সালের ১১ জুলাই একনেক সভায় এ প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্মাণকাজ উদ্বোধন করা হলেও শুরুতে ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পটির মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তৃতীয় দফায় ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তারও অনুমোদন পাওয়া গেছে।
শুরু থেকেই প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা জটিলতা দেখা দেয়। বিভিন্ন সংস্থার সাথে সমন্বয় না থাকায় কয়েক দফা নকশা বদল করতে হয়। বন্দরের সাথে কোনো ধরনের পরামর্শ ছাড়াই বন্দরের পাশ দিয়ে ফ্লাইওভারের নির্মাণের কাজ শুরু করে সিডিএ। পরে বন্দরের বাধার মুখে কাজ থমকে যায়। এরপর বন্দরের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করে নকশা বদল করা হয়। ট্রাফিক পুলিশের আপত্তির কারণেও দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ থাকে। দেওয়ানহাট থেকে টাইগারপাস অংশে এক্সপ্রেসওয়ের উচ্চতা নিয়ে রেলওয়ের সাথে জটিলতার সৃষ্টি হয়। অগ্রিম টাকা নিয়েও পাইপলাইন ও বিদ্যুতের লাইন সরাতে গড়িমসি করে চট্টগ্রাম ওয়াসা ও পিডিবি। এ কারণেও কাজের গতি বাধাগ্রস্ত হয়।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও বাসিন্দারা বলছেন, ধীরগতির পাশাপাশি সমন্বয়ের অভাবে জনদুর্ভোগ বাড়ছে। পাইলিং শেষ হওয়ার পরও সড়কের গর্ত ভরাট করা হচ্ছে না। আবার কোনো কোনো অংশে নালা-নর্দমা অংশের কাজ শুরু করেও তা ফেলে রাখা হয়েছে। সিমেন্ট ক্রসিং থেকে ইপিজেড অংশে পাইলিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে গত বছর। এরপর রাস্তার এক অংশে শুরু হয় নর্দমা সংস্কার কাজ। ওই কাজ শেষ হতে প্রায় ছয় মাস সময় লাগে। এখন অন্যপাশে চলছে সংস্কার। স্থানীয়রা জানান, ২০২০ সালে পাইলিং শুরু হওয়ার পর থেকে এখনো পর্যন্ত ওই এলাকায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। দ্রুত কাজ শেষ করা হলে এমন অবস্থা হতো না বলে স্থানীয়দের অভিমত।
এদিকে সংশোধনী প্রস্তাবে প্রকল্পের মূল ডিজাইন পরিবর্তন করা হয়েছে। আগের নকশায় পতেঙ্গা থেকে আসা এক্সপ্রেসওয়ে টাইগারপাস পাহাড়ের পাদদেশ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরে পাহাড় কাটা এবং টাইগারপাসের সৌন্দর্য নষ্ট হওয়া নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে আপত্তি উঠে। এ প্রেক্ষিতে পাহাড় না কাটার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নতুন ডিজাইনে বারিক বিল্ডিং থেকে আসা চার লেনের ফ্লাইওভার দেওয়ানহাটে ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাঙ্ক রোডে নির্মিত ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের পশ্চিম পাশ দিয়ে এসে টাইগারপাস পার হয়ে বর্তমান সিটি কর্পোরেশন কার্যালয়ের রাস্তার সামনে পৌঁছবে। চার লেনের এই ফ্লাইওভার পাহাড়ের দিকে না গিয়ে রাস্তার মাঝখানে থাকবে। এ অংশে পিলারও রাস্তার মাঝখানে হবে। সিটি কর্পোরেশনের কার্যালয়ের রাস্তা পর্যন্ত পৌঁছার পর চার লেনের ফ্লাইওভারের দুই লেন লালখান বাজার ইস্পাহানি মোড়ের আগে রাস্তায় নেমে যাবে।
বাকি দুই লেন রাস্তার মাঝখান দিয়ে ওয়াসা মোড়ে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের সাথে যুক্ত হবে। এতে পতেঙ্গা থেকে আসা গাড়িগুলো সড়ক পথে অল্পপথ গিয়ে প্রয়োজনে আবার ফ্লাইওভারে উঠবে কিংবা নিচ দিয়ে চলে যাবে। এই পয়েন্টে ফ্লাইওভারে ওঠা গাড়িগুলোর জন্য রাস্তা ডেডিকেটেড করে দেয়া হবে। অপরদিকে জিইসি মোড়ে পেনিনসুলা হোটেলের পাশ থেকে একটি র্যাম্প আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে যুক্ত করা হবে।
নগরীর নিউ মার্কেট থেকে আসা রাস্তার সাথে টাইগারপাস মোড়ে একটি র্যাম্প ফ্লাইওভারে যুক্ত হবে। যাতে মুরাদপুর, ষোলশহর ২নং গেইট, জিইসি মোড় এবং নিউ মার্কেট হয়ে আসা গাড়িগুলো ফ্লাইওভারে উঠতে পারে। আগের নকশা অনুযায়ী আগ্রাবাদ-বাদামতল, বারিক বিল্ডিং, নিমতলা, ইপিজেড ও সিমেন্ট ক্রসিং এলাকায় একাধিক র্যাম্প নির্মাণ করা হবে।
প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, সংশোধন প্রস্তাব অনুমোদন করায় এখন আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে কোনো সমস্যা নেই। আগের নকশা অনুযায়ী কাজ প্রায় ৭০ ভাগ শেষ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আশা করা যায় আগামী ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। সড়ক সংস্কার এবং ড্রেন নির্মাণ কাজের ধীরগতির বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন, বৃষ্টির কারণে কাজ কিছুটা বিঘ্নিত হচ্ছে। তবে খুব দ্রুত এসব কাজ শেষ করা হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন