এক সময়ের মসজিদের শহর ঢাকা এখন রিকশা আর যানজটের শহর। পথে নামলেই প্রতিদিনই দুর্বিষহ যানজটে পড়তে হয়। এই যানজট, গণপরিবহনের ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকার দৃশ্য পাল্টে যাবে আর কয়েক মাস পরেই। আগামী ডিসেম্বর মাসে চালু হবে মেট্রোরেলের একাংশ। আর ওই ডিসেম্বর মাসে চালুর লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ বিমানবন্দর থেকে বনানী রেলস্টেশন পর্যন্ত কাজ চলছে দ্রুত গতিতে। এই এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলেই পাল্টে যাবে রাজধানী ঢাকার সড়কের দৃশ্য। যানজট কমে আসবে, সড়কে মানুষের ভোগান্তি কমবে।
জানতে চাইলে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মামুন-আল-রশীদ ইনকিলাবকে বলেন, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি খুলে দেয়া হলে রাজধানীর যানজট কমাতে সহায়তা করবে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসবে। দীর্ঘদিনের রাজধানীর যে সমস্যা এর অনেকাংশে কমে আসবে। উত্তরা থেকে ঢাকার দক্ষিণ অংশে যেতে নগরবাসীকে যে কষ্ট করতে হয় তা অনেক কমবে। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্পের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর ওয়াং ড্যাং পেন বলেন, আমাদের কাজ খুব দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছে, যে প্রতিবন্ধকতা আছে, আশা করছি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করেই মিটিয়ে নেয়া যাবে। ডিসেম্বরেই একাংশ চালু করতে পারবো।
জানা গেছে, রাজধানীর সড়কগুলোতে প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহনের চাপ থাকায় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের নির্মাণের সুবিধার্থে তিনটি ট্রাঞ্চে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম অংশ বিমানবন্দর থেকে বনানী রেলস্টেশন পর্যন্ত। দ্বিতীয়াংশ বনানী রেলস্টেশন থেকে মগবাজার পর্যন্ত। তৃতীয়াংশ মগবাজার থেকে যাত্রাবাড়ির পেরিয়ে চিটাগাং রোডের কুতুবখালী পর্যন্ত। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি ঢাকার উত্তর-দক্ষিণে বিকল্প সড়ক হিসাবে ব্যবহৃত হবে। এটি সম্পূর্ণ চালু হলে রাজধানী ঢাকায় যানজটের দৃশ্য হারিয়ে যাবে। রাজধানী ঢাকাকে আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে নানামুখি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে মহানগরীর যানজট নিরসনে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের মহাপ্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে নগরীর দুর্বিষহ যানজটের ভোগান্তি থেকে অনেটাই রেহাই পাবে নগরবাসী এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের। বর্তমান সময়ে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিভিন্ন অংশের কাজ রয়েছে চলমান। কাজের অগ্রগতির সাথে সাথে জেগে উঠছে নতুন স্বপ্ন। যানজট মুক্ত নতুন একটি আধুনিক ঢাকা বিনির্মাণে প্রকল্পটি কাজ করবে যাদুরকাঠির মতো। প্রকল্পটির কাজে এসেছে গতি। ভারী যন্ত্রপাতির সাহায্যে দেশি-বিদেশি শ্রমিকরা-কর্মকর্তারা মহাব্যস্ত প্রকল্পটির কাজে। কাজের অগ্রগতির নিয়মিত খোঁজ খবর রাখছেন কর্মকর্তারা।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে চলমান বিভিন্ন স্থান সরেমজিন ঘুরে এমনটাই দেখা গেছে। নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে একাংশের কাজ এগিয়ে চলছে। তিনটি ভাগে প্রকল্পের কাজ ভাগ করা হয়েছে। প্রথমপর্ব বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও অর্থাৎ প্রথম অংশের সঙ্গে দ্বিতীয় অংশের অংশবিশেষ নিয়ে চালু হচ্ছে চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ-পিপিপির আওতায় পরিচালিত এ অংশের কাজ শেষ হয়েছে ৮০ ভাগের বেশি।
জানা গেছে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি নির্মাণের সুবিধার্থে তিনটি ট্রাঞ্চে ভাগ করা হয়। বিমানবন্দর থেকে বনানী রেলস্টেশন পর্যন্ত। বনানী রেলস্টেশন থেকে মগবাজার পর্যন্ত। মগবাজার থেকে চিটাগাং রোডের কুতুবখালী পর্যন্ত। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি ঢাকার উত্তর-দক্ষিণে বিকল্প সড়ক হিসাবে কাজ করবে। এটি হেমায়েতপুর-কদমতলী-নিমতলী-সিরাজদিখান-মদনগঞ্জ-ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক-মদনপুরে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করবে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ পূর্বাঞ্চল ও পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যানবাহন ঢাকায় প্রবেশ না করে সরাসরি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রবেশ করবে, অন্য জেলায় চলে যাবে। আবার উত্তরাঞ্চল থেকে আসা যানবাহনগুলোও ঢাকাকে পাশ কাটিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সরাসরি যাতায়াত করতে পারবে। ফলে ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার যানবাহনের চাপ কমে গেলে যানজটও কমবে। যোগাযোগ ব্যয় ও ঢাকা শহরের যানজট অনেকাংশে কমে যাবে। কমবে ভ্রমণের সময় ও খরচও। যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজীকরণ ও আধুনিকায়নের পাশাপাশি এ প্রকল্প দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলবে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূল এক্সপ্রেসওয়ে ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করছে থাইল্যান্ডভিত্তিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড, চীনের শ্যাংডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল করপোরেশন গ্রুপ লিমিটেড (সিএসআই) ও দেশটির রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সিনো-হাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড। এজন্য ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (এফডিইই) নামে একটি বেসরকারি কোম্পানিও গঠন করা হয়েছে। প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে সহায়তা করছে সরকার। প্রকল্প বাস্তবায়নে বৈশ্বিক মহামারী করোনার মধ্যেও কাজ করেছেন কর্মীরা। প্রকল্পের একটা বড় বাধা ছিল ভূমি অধিগ্রহণ। প্রকল্পের ২১০ একর জমির মধ্যে রেলের জমি ১২৮ একর, সড়ক ও জনপথ বিভাগের ২৭ একর। সাধারণ মানুষের ২৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। বাকি জমি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। জমি অধিগ্রহণ করে ঘর-বাড়ি স্থাপনা ভেঙে প্রকল্পের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে কিছু অতিরিক্ত সময় লেগে গেছে।
সরেজমিন ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী ডিসেম্বর মাসেই চালু হবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও অংশ। তবে নানা জটিলতায় বাধার মুখে পড়েছে দ্বিতীয় পর্বের নির্মাণকাজ। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরের অংশে কাজ করতে অন্তত ছয়টি প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। এ পথে টোল হার সহনীয় রাখার আশ্বাস দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ইতোমধ্যে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছেন পিপিপির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ ইব্রাহীমসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ। তারা কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজ খবর রাখছেন।
পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ অথরিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ ইব্রাহীম বলেন, প্রথম ধাপের কাজ নির্বিঘ্নে হলেও দ্বিতীয় ধাপ অর্থাৎ তেজগাঁও থেকে চিটাগাং রোডের কুতুবখালি পর্যন্ত যেতে পড়তে হচ্ছে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতায়। হাতিরঝিল, কমলাপুরসহ ঢাকা দক্ষিণ সিটির সঙ্গে প্রকল্পের তৈরি হয়েছে বেশ কিছু সমস্যা। হাতিরঝিল, কমলাপুরসহ ঢাকা দক্ষিণ সিটির সঙ্গে প্রকল্পের তৈরি হয়েছে বেশ কিছু সাংঘর্ষিকতা, তবে আশা করছি এগুলো মিটিয়ে ফেলতে পারব। সবার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজটি করা হবে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে সহজ যাতায়াত ব্যবস্থা তৈরি করবে। পাশাপাশি ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও ব্যবসাকেন্দ্রকে সংযুক্ত করবে। যানজট যেমন কমাবে, তেমনি নগরবাসীর জন্য আরামদায়ক ও সুবিধাজনক যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে উঠবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পটির কাজ শেষ করতে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, বিমানবন্দর থেকে কুড়িল পর্যন্ত উঠে গেছে ভায়াডাক্ট। সøাব বসানো প্রায় শেষ, উপরের অংশে ফিনিসিংয়ের কাজ করছেন শ্রমিকরা। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত ডিসেম্বর নাগাদ খুলে দেয়া সম্ভব হবে বলে আশা করছে প্রকল্পের পরিচালনা কর্তৃপক্ষ। ডিসেম্বর চালুর টার্গেট করে দ্রুত কাজ এগিয়ে চলেছে। প্রচন্ড রোদ ও মাঝে মাঝে বৃষ্টিতে বিরুপ আবহাওয়াও কাজের কোন সমস্যা সৃষ্টি করতে পারেনি। শ্রমিকরা মনোযোগের সাথে কাজ করছেন। বিমানবন্দর এলাকায় দেখা গেছে, প্রচন্ড রোদের মধ্যেও কাজ করছেন শ্রমিকরা। মূল সড়কের পাশের নিরাপত্তা বেরি দেয়ার সøাব বসানো হচ্ছে। রডের কাজ করছেন শ্রমিকরা। নিকুঞ্জ এলাকায় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সবগুলো সøাব বসানোর পর উপরে কাজে ব্যস্ত শত শত শ্রমিক। প্রচন্ড গরম উপেক্ষা করে শ্রমিকরা রড বাঁধছেন। চলছে ঢালাইয়ের কাজ। উপরে ও নিচে সব স্থানই কাজে ব্যস্ত তারা।
এই প্রকল্পে শ্রমিকের কাজ করছেন গাইবান্দার ইমন। তিনি জানিয়েছেন, প্রকল্পটিতে কাজ করতে পেরে ভালো লাগছে। প্রায় ছয় মাস ধরে এখানে কাজ করছি। সবকিছুই ভালো, যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হলে তখন আরও ভালো লাগবে। বলতে পারবো এই প্রকল্পে আমি কাজ করেছি। ডিসেম্বরে খুলে দেয়া হবে বলে শুনেছি। দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের জন্য কাজ করছি এটাতো আমার জন্য বড় বিষয়।
টঙ্গী থেকে মতিঝিল সড়কে নিয়মিত চলাচলকারী আলী নূর হোসেন বলেন, প্রতিদিনই আমাকে বাসে অথবা ট্রেনে যাতায়াত করতে হয়। ট্রেনে কোন কোন দিন উঠতে পারিনা। মাসের বেশিরভাগ দিনগুলোতে বাসেই যাতায়াত করতে হয়। আর বাসে যাতায়াত মানে কিযে দুর্ভোগ এটা যারা ঢাকায় বসবাস না করে তারা বলতে পারবে না। এতা কষ্ট করে নিয়মিত কাজে যেতে হয়। চাকরির তাগিদেই এতো কষ্ট করছি। যদি ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প খুলে দেয়া হয় তাহলে আমরাই সবচেয়ে সুবিধাভোগী হবো। কারণ নিয়মিত যাতায়াতে স্বাচ্ছন্ন আসবে। ঠিক সময়ে নিশ্চিন্তে অফিস করতে পারবো। নূর হোসেনের মতো টঙ্গী ও উত্তরা থেকে মতিঝিলে নিয়মিত আসাযাওয়া করেন এমন যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে তারা সবাই বলেন, স্বপ্ন দেখছি ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে। কয়েক মাস পর একাংশ চালু হবে। তখন যানজটে পড়তে হবে না। ###
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন