ঢাকা এলিভেটেড এক্সসেওয়ের নকশায় বদল করা হয়েছে চারবার। তার পরও চূড়ান্ত হয়নি গতিপথ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন পলাশীতে একটি র্যাম্প (সংযোগ সড়ক) নিয়ে নতুন করে জটিলতা তৈরি হয়েছে। অতি ধীরগতিতে এগিয়ে প্রায় মাঝপথে এসে থমকে গেছে এর নির্মাণ কাজ।
২০১০ সালে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শুরু করে সেতু বিভাগ। চালু হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। নির্ধারিত সময়ে নির্মাণকাজের কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ২০২০ সাল পর্যন্ত। রাজধানীর যানজট নিরসনে সরকারের নেয়া মেগাপ্রকল্পগুলোর অন্যতম ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। যানজট নিরসনতো দুরে থাক নির্মাণের ধীর গতির কারণে এখন এটি নগরবাসীর ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনটি ধাপে বাস্তবায়ন হচ্ছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। প্রথম ধাপে বিমানবন্দর-বনানী, দ্বিতীয় ধাপে বনানী-তেজগাঁও ও তৃতীয় ধাপে মগবাজার-কুতুবখালী অংশে কাজ হবে। বর্তমানে বিমানবন্দর-বনানী অংশে এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ চলছে। বনানী-তেজগাঁও অংশটি দখলমুক্ত করার কাজ চলমান। আর মগবাজার-কুতুবখালী অংশটির কাজ এখনো শুরুই হয়নি। এজন্য পূনঃনির্ধারিত সময়ে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে কি না তা নিয়েও সন্দেহ দেখা দিয়েছে। সে হিসাবে এটির কারণে আরও অনেক সময় ভোগান্তি পোহাতে হবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকার বিমানবন্দর এলাকা থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মাণ করা হবে প্রায় ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। ছয় লেনবিশিষ্ট এক্সপ্রেসওয়েটির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ একটি লিংকওয়ে নির্মাণ করা হবে হোটেল সোনারগাঁও থেকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) পর্যন্ত। তবে পুরো এক্সপ্রেসওয়েটির সঙ্গে ঢাকায় চলমান ও প্রস্তাবিত অন্যান্য প্রকল্পের সাংঘর্ষিক অবস্থা তৈরি হয়েছে। এতে প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়নেই জটিলতা দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিষয়গুলো সমাধানে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) কার্যালয়ে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে জানানো হয়, এক্সপ্রেসওয়ের জন্য নির্মাণাধীন বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি), মেট্রোরেল, ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন রেলপথ, বিমানবন্দর টার্মিনাল-৩-এর সাংঘর্ষিক অবস্থা রয়েছে। পাশাপাশি এক্সপ্রেসওয়ের পিলারের কারণে হাতিরঝিলের পানি প্রবাহ ও পান্থকুঞ্জের পার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সোনারগাঁও-বুয়েট লিংক অংশটি সোনারগাঁও হোটেল সংলগ্ন হাতিরঝিলের উত্তর পাশ দিয়ে পান্থকুঞ্জ পার্কের ভেতর দিয়ে হাতিরপুল, কাঁটাবন হয়ে পলাশী পর্যন্ত নির্মাণের কথা রয়েছে। সভায় জানানো হয়, এতে ৫৪টি পিলার হাতিরঝিলের পানির মধ্যে পড়বে। এছাড়া পান্থকুঞ্জ পার্কের ভেতরেও কয়েকটি পিলার পড়বে। এতে হাতিরঝিলের পানি প্রবাহ ও পান্থকুঞ্জের সৌন্দর্য বিনষ্ট হবে। বিষয়টি বিবেচনায় ২০১৭ সালের ১ জুন এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হাতিরঝিলের ওপর দিয়ে র্যাম্প না নেওয়ার নির্দেশ দেন।
এর পরিপ্রেক্ষিতে হাতিরঝিলের সৌন্দর্য অক্ষুন্ন রেখে ও যথাসম্ভব পানিতে পিলার পরিহার করে সোনারগাঁও-বুয়েট লিংক অংশের নকশা পুননির্মাণে অনুরোধ করা হয় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানকে। এতে নতুন করে নকশা করা হয়েছে লিংক অংশটির।
বৈঠকে সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাকলি ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় সড়কের মিডিয়ানে ১৩টি পিলার নির্মাণ করা হবে। এগুলোর ওরিয়েন্টেশন মিডিয়ান বরাবর না করে কোনাকুনি করা হয়েছে। এতে বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নে জটিলতা হবে। আর বিআরটি রাস্তার মাঝখানে দুই লেন বরাবর হবে। বাকি লেনগুলো দিয়ে সাধারণ যানবাহন চলাচল করবে। তাই ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিলারের জন্য বিআরটি লেন সরিয়ে নিতে হবে। এতে সাধারণ যানবাহন চলাচলের লেন সংকুচিত হবে। এই জটিলতা এড়াতে বিআরটি’র সঙ্গে সাংঘর্ষিক স্থানে জমি অধিগ্রহণ করে সড়ক প্রশস্ত করার আশ্বাস দেওয়া হয় বৈঠকে। এছাড়া এয়ারপোর্ট টার্মিনাল-৩ প্রকল্পের নকশার সঙ্গে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সমন্বয় করা প্রয়োজন বলেও বৈঠকে পরামর্শ দেওয়া হয়।
এদিকে প্রস্তাবিত এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে মেট্রোরেল প্রকল্প (এমআরটি-৫) এর পশ্চিমাংশের সাংঘর্ষিক অবস্থা রয়েছে। মেট্রোরেলের এ অংশটি গাবতলী থেকে টেকনিক্যাল, কল্যাণপুর, শ্যামলী, কলেজ গেট, আসাদ গেট, রাসেল স্কয়ার, পান্থপথ, সোনারগাঁও, হাতিরঝিল, নিকেতন, রামপুরা, আফতাবনগর পশ্চিম, আফতাবনগর কেন্দ্র, আফতাবনগর পূর্ব হয়ে দাশেরকান্দি পর্যন্ত যাবে। ফ্লাইওভার ও মাটির নিচ (টানেল) মিলিয়ে এ অংশের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৭ কিলোমিটার। এ রুটে ১৭টি স্টেশন থাকবে।
ডিটিসিএ-এর বৈঠকে জানানো হয়, এফডিসি গেটের সামনে মগবাজার ফ্লাইওভারের একটি পিলার আছে। তার পাশেই এক্সপ্রেসওয়ের পাঁচটি পিলার নির্মাণ করা হবে। এ পিলারগুলো থাকলে এমআরটি-৫-এর দক্ষিণাংশের টানেল মাটির ৪০ মিটার নিচ দিয়ে নির্মাণ করতে হবে, যা খুবই ব্যয়বহুল। এছাড়া এক্সপ্রেসওয়ের পিলারগুলোর কারণে হাতিরঝিল স্টেশন নির্মাণ করাও দুরূহ হয়ে পড়বে।
এরই মধ্যে মগবাজার ফ্লাইওভারের জন্য এক্সপ্রেসওয়ের পিলারের প্রস্থ ৪০ মিটার নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানিয়ে বৈঠকে বলা হয়, টেকনিক্যালি এর প্রস্থ আর পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।
এদিকে গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের র্যাম্পগুলো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রাবাড়ীর কুতুবখালী নামক জায়গায় মিলিত হবে। এক্ষেত্রে হানিফ ফ্লাইওভারের টাচ ডাউন পয়েন্ট ও এক্সপ্রেসওয়ের টাচ ডাউন পয়েন্ট কাছাকাছি। এতে হানিফ ফ্লাইওভারের টোল আদায় কমে যাওয়ার শঙ্কা করা হচ্ছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা-টঙ্গী তৃতীয় ও চতুর্থ লাইন রেলপথসহ আরও প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তাই রেলের সঙ্গে এক্সপ্রেসওয়ের সমন্বয় করা প্রয়োজন বলেও বৈঠকে জানানো হয়। এছাড়া কমলাপুর আইসিডির সঙ্গেও এক্সপ্রেসওয়ের অ্যালাইনমেন্ট সমন্বয় করতে হবে।
সূত্র জানায়, বৈঠকে একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটি বেসরকারি বিনিয়োগ প্রকল্প। যদি কোনো কারণে এর নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি পায়, তাহলে বিনিয়োগকারীকে আরও ব্যাংক ঋণ নিতে হবে। এতে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হবে। এমনিতেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আর বেসরকারি বিনিয়োগ প্রকল্প হওয়ায় বারবার এর ডিজাইন পরিবর্তন ও ব্যয় বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়।
এভাবে বারবার কাটছাঁট করে সরকার প্রকল্পটির বাস্তবায়নযোগ্যতা নষ্ট করছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সামছুল হক। তিনি বলেন, এরই মধ্যে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নকশায় চারবার পরিবর্তন আনা হয়েছে। গতিপথ বদল করা হয়েছে। একতরফাভাবে অনেকগুলো র্যাম্প ছেঁটে ফেলা হয়েছে। হাতিরঝিলের ভেতর দিয়ে র্যাম্প নামতে দেয়া হবে না। পলাশীর র্যাম্প নিয়েও অনিশ্চয়তা আছে। এর ফলে হাতিরঝিল ও পলাশী র্যাম্প দিয়ে যে রাজস্ব আয়ের হিসাব বিনিয়োগকারীরা করে রেখেছিলেন, সেগুলো থেকে তারা বঞ্চিত হবেন। কারণ, পিপিপি প্রকল্পে বিনিয়োগকারীর একটা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য থাকে। গতিপথ বদলানো, অনেকগুলো র্যাম্প বাদ দেয়ার ফলে সে উদ্দেশ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গতিপথে জটিলতার পাশাপাশি মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক হয়ে গেছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। তাদের মতে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দুইভাবে হানিফ ফ্লাইওভারের ক্ষতি করবে। প্রথমত, নির্মাণকালে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ফ্লাইওভারের অবকাঠামো। দ্বিতীয়ত, হানিফ ফ্লাইওভারের রাজস্ব আয়ে ভাগ বসাবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে।
হানিফ ফ্লাইওভার নির্মাণকালে সেই প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহজাহান আলী পাটোয়ারি। তিনি মনে করছেন, প্রকৌশলগত ও নির্মাণ ব্যয় হিসাবে ধরলে এটি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। সায়েদাবাদ থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত হানিফ ফ্লাইওভারের তিনটা লেভেল (তিনতলা) আছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বানাতে হলে তা চতুর্থ লেভেলে করতে হবে। এত উপরে অবকাঠামো নির্মাণ একদিকে যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি নির্মাণকালে হানিফ ফ্লাইওভারকে সেটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। একই পথে দুটি পিপিপি প্রকল্প সাংঘর্ষিক।
অনেকের মতে, নির্মাণকাজের এসব জটিলতার কারণে রাজধানীবাসীর ভোগান্তি নিরসনে নেয়া মেগা প্রকল্প এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ক্রমে নগরবাসীর ভোগান্তি বাড়াচ্ছে। নির্মাণ জটিলতায় আগামীতে এ ভোগান্তি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন