রাজধানীর আব্দুল্লাহপুর থেকে আশুলিয়া-বাইপাইল হয়ে সাভার ইপিজেড পর্যন্ত মহাসড়কটি যান চলাচলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই মহাসড়কেই ঢাকার বিমানবন্দর থেকে সাভার ইপিজেড পর্যন্ত ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছে সরকার। এক্সপ্রেসওয়েটি নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হচ্ছে প্রায় ৭০৪ কোটি টাকা। দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ এক্সপ্রেসওয়ের জন্য পরীক্ষামূলক পাইলিংয়ের কাজ চলছে। তবে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের প্রাক-প্রস্তুতি না থাকায় ভোগান্তি দিন দিন বাড়ছেই। মহাসড়কটির দুই পাশে অবৈধ স্থাপনা ও যত্রতত্র গাড়ি পার্ক করে যাত্রী উঠানামার কারণে প্রতিনিয়ত যানজট লেগেই থাকে। এ যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশকেও হিমশিম খেতে হয়। সড়কের পাশ থেকে অবৈধ ভাবে গড়ে উঠা দোকান পাট সরিয়ে দিলে যানজট লাঘব হবে বলে মনে করেন সচেতন মহল। এই মহাসড়ক ব্যবহারকারিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের টঙ্গী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিআরটি নির্মাণকাজ চলছে প্রায় এক যুগ ধরে। এতে করে ভোগান্তি এড়াতে বেশিরভাগ যানবাহন আশুলিয়া মহাসড়ক ব্যবহার করে থাকে। অথচ সড়ক ও জনপথ বিভাগের সামান্যতম নজর নেই এই মহাসড়কে। বর্ষায় চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়লে ইট বিছিয়ে জোড়াতালি দিয়ে সড়ক মেরামত করা হয়। বর্ষা যেতে না যেতে সেগুলো ভেঙে একাকার হয়ে আছে।
সরেজমিনে ডিইপিজেড থেকে আশুলিয়া সেতু পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, এই মহাসড়কের বেশ কয়েকটি স্থানে সড়কের দুই পাশে সরকারি জায়গা দখল করে পাকা দালান, আধা পাকা, দোচালা-চৌচাল টিনের দোকান টং দোকান নির্মাণ করা হয়েছে। সড়কের দুই পাশ দখল করে ওয়ার্কশপ ব্যবসাও করছেন কেউ কেউ। আবার এসব স্থাপনার সামনে বিভিন্ন যানবাহন পাকিং করে রাখায় সড়ক দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। যানজট সৃষ্টির পাশাপাশি প্রায়ই ঘটছে নানা ধরনের দূর্ঘটনা।
স্থানীয়রা জানান, এসব অবৈধ স্থাপনা রাতারাতি গড়ে ওঠেনি। সওজের লোকজনের চোখের সামনেই সেগুলো বহুদিন ধরে গড়ে উঠেছে। মাঝেমধ্যে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়, কিন্তু কিছুদিন পরেই আবার সেগুলো গড়ে ওঠে। এটাও ঘটে সওজের লোকজনের জ্ঞাতসারেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দোকান মালিক বলেন, ঘর তোলার সময় সওজের লোক, স্থানীয় নেতারা এসেছিল,তাঁদের ম্যানেজ করেই ঘর তোলা হয়েছে। এই ‘ম্যানেজ করা’র ফলেই সরকারি জায়গা–জমিতে অবৈধ স্থাপনা গড়ে ওঠা সম্ভব হয়। এসব বন্ধ করতে হলে সর্ষের মধ্যেকার ভূত তাড়াতে হবে বলে মনে করেন অনেকেই।
এদিকে আব্দুল্লাহপুর- আশুলিয়া মহাসড়কের বাইপাইল থেকে জিরাব পর্যন্ত সড়কের পাশের অবৈধভাবে গড়ে ওঠা অর্ধ শতাধিক ভাঙারির দোকান প্রতি মাসে কয়েক লক্ষ টাকা চাঁদা নিচ্ছে একটি চক্র।
সরেজমিন দেখা গেছে, অবৈধভাবে রাতারাতি গড়ে উঠেছে টিনসেট এসব ভাঙারি দোকান। তাদের থেকে মাসোহারা নিচ্ছে একটি চক্র। ভাঙারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চাঁদার টাকা আদায়ের জন্য বাবুল নামের এক ব্যক্তিকে নিয়োজিত করা হয়েছে। তিনি এসব দোকান থেকে প্রতিমাসে প্রায় কয়েক লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেন।
ব্যবসায়ীরা জানান, বড় দোকান থেকে প্রতিমাসে ১০-১৫ হাজার টাকা, ছোট দোকান থেকে ৫ হাজার ও মাঝারি ধরনের দোকান থেকে ৮ হাজার করে মাসিক চাঁদা আদায় করা হয়। তবে চাঁদার টাকা কাদের দিতে হয় এমন প্রশ্ন করলে ব্যবসায়রিা তাদের নাম প্রকাশ না করে বলেন, স্থানীয় নেতাদের লোকজন এসে নিয়ে যায়। তাদের টাকা না দিলে দোকান পেতাম না।
ঢাকা জেলা ট্রাফিক পুলিশের ইন্সপেক্টর (টিআই) মো. আব্দুস সালাম জানান, আব্দুল্লাহপুর-আশুলিয়া মহাসড়কের বাইপাইল থেকে আশুলিয়া সেতু পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে অবৈধ স্থাপনা ও বিভিন্ন গাড়ি পার্কিং করে মালামাল নামানো উঠানোর ফলে বেশি যানজটে সৃষ্টি হচ্ছে। আমাদের ট্রাফিক পুলিশ এসব নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে হিম শিম খাচ্ছে। সড়কের দুই পাশে স্থাপনা না থাকলে এই সড়কটিতে কোন যানজট হতোই না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এদিকে ডিইপিজেড থেকে বলিবদ্র বাজার পর্যন্ত মহাসড়কের ফুটপাত দখল করে দোকানপাট বসিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ চাঁদাবাজি করে আসছেন আতিক ও জাহাঙ্গীর নামে দুই ব্যক্তি। আবার মহাসড়কের উপর ভ্রাম্যমাণ দোকান বসিয়েও চাঁদা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে এদের বিরুদ্ধে। ফুটপাত ব্যাবসায়ীরা জানান, এদের টাকা না দিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব নয়। এখানে দোকান নিয়ে আসলেই দোকান বুঝে ২০০-৫০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়।
মহাসড়কের পাশে এসব অবৈধ দোকান বসানোর কারনে পোশাক কারখানা ছটির পর দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। ফলে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
সড়ক ও জনপথ বিভাগ বিভিন্ন সময় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করলেও কোন এক অদৃশ্য কারণে স্থায়ী হচ্ছে না উচ্ছেদ অভিযান। এ প্রসঙ্গে জানতে সড়ক ও জনপদ বিভাগ ঢাকা জেলার সহকারী প্রকৌশলী মো. আলমগীর রেজাউল করিম এর মোবাইল ফোনে একাধিকবার চেষ্টা করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। তবে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পুরোদমে কাজ শুরু হলে কোন অবৈধ স্থাপনাই আর থাকবে না। এ প্রসঙ্গে সেতু বিভাগের সচিব আবু বকর সিদ্দিক বলেন, পুরোদমে কাজ এখনও শুরু হয়নি। কাজ শুরুর আগে প্রথমেই বিকল্প সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হবে। তখন অবৈধ স্থাপনা বলে কিছুই থাকবে না।
প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য পরীক্ষামূলক পাইলিংয়ের মাধ্যমে মাটির ধারণক্ষমতা যাচাই করা হচ্ছে। পুরো প্রকল্প এলাকায় সব মিলিয়ে ২২টি পরীক্ষামূলক পাইলিং করা হবে, যার এখনও চলমান। এগুলো মূলত এক্সপ্রেসওয়ের নকশা প্রণয়ন কাজেরই অংশ। পরীক্ষামূলক পাইলিং শেষ হলেই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করা হবে নির্মাণকাজ।
বিমানবন্দর ইন্টারসেকশন থেকে শুরু হয়ে আব্দুল্লাপুর-আশুলিয়া-বাইপাইল দিয়ে ইপিজেড পর্যন্ত অংশে নির্মাণ করা হবে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। মূল এক্সপ্রেসওয়েূর দৈর্ঘ্য ২৪ কিলোমিটার। বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠানামার জন্য তৈরি করা হবে ১৬টি র্যাম্প বা সংযোগ সড়ক। র্যাম্পগুলোর সম্মিলিত দৈর্ঘ্য প্রায় ১০ কিলোমিটার। এ প্রকল্পে এলিভেটেড ছাড়াও ১৪ কিলোমিটারের বেশি সড়ক নির্মাণ করা হবে। পাশাপাশি নবীনগর এলাকায় নির্মাণ করা হবে ১ দশমিক ৯৫ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি ফ্লাইওভার, ২ দশমিক ৭২ কিলোমিটার সেতু, ৫০০ মিটার ওভারপাস, ইউটিলিটির জন্য ১৮ কিলোমিটার ড্রেনেজ ও ডাক্ট এবং পাঁচটি টোল প্লাজা।
প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, ঢাকা ও আশুলিয়া-সাভার এলাকার যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখবে এ এক্সপ্রেসওয়ে। এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত হয়ে তৈরি করবে আন্তঃদেশীয় সড়ক যোগাযোগের সুযোগ। বিমানবন্দর এলাকায় ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে সংযুক্ত হবে নির্মাণাধীন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে। এর ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, ঢাকা-জামালপুর মহাসড়ক, ঢাকা-মানিকগঞ্জ-তেঁতুলিয়া মহাসড়ক, ঢাকা-মাওয়া-বরিশাল মহাসড়কের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করবে এ প্রকল্প। এক্সপ্রেসওয়েটি ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট হারে টোল দিতে হবে যানবাহনগুলোকে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন