আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত মানব জাতিকে অত্যন্ত মায়া ও মহব্বত করে সৃষ্টি করেছেন। মানব জাতির উৎসমূল এবং তার সম্প্রসারণ ও বিস্তুতির রূপ রেখার বিবরণ তিনি আল কোরআনে এভাবে বিবৃত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে : হে মানবজাতি! নিশ্চয় আমি তোমাদেরকে একজন নারী এবং একজন পুরুষ থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি। যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সেই ব্যক্তি অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক তাকওয়াসম্পন্ন। নিশ্চয় আল্লাহপাক সর্বজ্ঞ, সম্যক অবহিত। (সূরা হুযুরাত : ১৩)।
মানব জাতির আদি মাতা মা হাওয়া (আ.) এবং আদি পিতা হযরত আদম (আ.)। তাদের উভয়ের বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার ফলে আদি আত্মীয়তার উৎস রচিত হয়েছে এবং আত্মীয়তার মাধ্যমেই পৃথিবী জোড়া মানবজাতি ও গোত্র নিজ নিজ পরিচিতি ও বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা ও তদবীর চালিয়ে যাচ্ছে।
মহান আল্লাহপাক মানুষকে দুনিয়ার স্বীয় প্রতিনিধি করেছেন। প্রতিনিধিত্বশীল দায়িত্ব ও কর্তব্য নিষ্পন্ন করার জন্য যে সকল জ্ঞান-বিদ্যা, বুদ্ধি কৌশল ও অধ্যবসায়ের প্রয়োজন মানুষকে তা’ দান করেছেন। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, পিয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : দুনিয়া অবশ্যই মিষ্টি ও আকর্ষণীয়। আল্লাহ তোমাদেরকে দুনিয়ায় তাঁর প্রতিনিধি করেছেন। যাতে তিনি পরখ করতে পারেন তোমরা কেমন কাজ করো। কাজেই তোমরা দুনিয়া থেকে বাঁচো এবং নারীদের (ফিতনা) থেকেও বাঁচো। কারণ বণী ইসরাঈলের প্রথম ফিতনা নারীদের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়েছিল। (সহীহ মুসলিম)।
যেহেতু মানব বংশ বৃদ্ধির ধারা আত্মীয়তার পথ ধরেই ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়ে চলেছে, তাই আত্মীয়তার হক বা অধিকার যথাযথভাবে আদায় করার জন্য আল্লাহ তায়ালা মানুষকে নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : ‘ওয়া ইতাইজিল্ কুবরা’ অর্থাৎ তোমাদেরকে আত্মীয় স্বজনদের অধিকার প্রদানের নির্দেশ দেয়া হচ্ছে। (সূরা নাহল : ৯০)। তাছাড়াও আত্মীয়তার সম্পর্কের কথা বিবৃত হয়েছে সূরা বাকারাহ’র ৮৩ ও ১৭৭ নং আয়াতে। সূরা নিসা এর ৮ ও ৩৬ নং আয়াতে। এগুলো ছাড়া আরো অনেক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা আত্মীয়তার হক সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, আল্লাহপাক আল কোরআনের ১৬টি স্থানে আত্মীয়তার হক আদায়ের তাকিদ করেছেন।
তাই, প্রত্যেক আত্মীয়ের হক ষোলআনাভাবে আদায় করতে হবে। কমপক্ষে তাদের সাথে সুন্দরভাবে জীবন যাপন করতে হবে ও সদ্ব্যবহার করতে হবে। যদি তারা অভাবগ্রস্ত হয়, তবে সামর্থ্য অনুযায়ী তাদের আর্থিক সাহায্য ও এর অন্তর্ভুক্ত। সূরা বণী ইসরাঈলের ২৬ নং আয়াতের নির্দেশ দ্বারা এতটুকু বিষয় অবশ্যই প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রত্যেকের ওপরই তার সাধারণ আত্মীয়দেরও হক রয়েছে। সে হক কি এবং কতটুকু তার বিশদ বর্ণনা আল কোরআন ও সুন্নাতে নববীতে বিদ্যমান আছে।
এতদ প্রসঙ্গে ইমামে আজম, ইমাম আবু হানীফা (রহ.) বলেন : যাদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ-এমন আত্মীয় মহিলা, বালক-বালিকা যদি নিঃস্ব হয় এবং উপার্জন করতে সক্ষম না হয়, অনুরূপভাবে সে যদি বিকলাঙ্গ কিংবা অন্ধ হয়, জীবন ধারণের মতো ধন-সম্পদের মালিক না হয়, তবে তার ভরণ-পোষণ করা সক্ষম ও সঙ্গতি-সম্পন্ন আত্মীয়দের ওপর ফরয। যদি একই স্তরে কয়েকজন আত্মীয় সক্ষম হয়, তাহলে ভরণ-পোষণের দায়িত্ব ভাগাভাগী করে তাদের কয়েকজনকেই বহন করতে হবে।
সূরা বাকারাহর ২৩৩ নং আয়াতের বাণী ‘ওয়া আলাল ওয়ারিছে মিছলু যালিকা’ অর্থাৎ এবং ওয়ারিশদের ওপর ও অনুরূপ দায়িত্ব এই নির্দেশের দ্বারা প্রমাণিত হয়। তবে, নিতান্ত অনুতাপ ও দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে যে, চলমান দুনিয়ার মানুষ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.)-এর আদেশের প্রতি কোনোই ভ্রক্ষেপ করছে না। বরং আত্মীয় স্বজনদের হক কে কত বেশি গ্রাস করতে পারে, এই প্রতিযোগীতায় কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে। পৃথিবী জোড়া এই অন্যায় ও অবিচারের সয়লাব বয়ে চলেছে ক্ষীপ্র গতিতে। পরিণামে এই সাধের পৃথিবী আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতির যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে ধ্বংসের দোর গোড়ায় পৌঁছে গেছে বলেই মনে হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন