ভালোবাসা হলো হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের সম্পর্ক। আত্মার সাথে আত্মার বন্ধন। ভালোবাসা মানে হলো হৃদয়ের মণিকোঠায় কাউকে ঠাঁই দিয়ে সবকিছু তাকে সঁপে দেওয়া। ভালোবাসা মানে যাকে ভালোবাসি তার প্রতি হৃদয়ের গভীরে লালন করা এক অসীম আকর্ষণ, যে আকর্ষণের তীব্রতায় যাকে আমি ভালোবাসি তার সান্নিধ্য পেতে ব্যাকুল হই, তার দর্শনলাভে অধীর হই এবং তাকে গ্রহণ ও বরণ করতে হৃদয়ের সমস্ত দরজা উন্মুক্ত করে দেই। ভালোবাসা হলো হৃদয়ের মাঝে সদা অনুরণিত এক ঝংকার, এক অফুরন্ত সুখ-স্বাদ, এক অনির্বচনীয় স্নিগ্ধ আবেগ, যা রক্তধারায় মিশে গিয়ে সর্বসত্তায় আলোড়ন জাগায়। যার প্রকাশ ঘটে আমার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ ও বাক্যে, আমার নিত্যদিনের আচরণ ও কর্মে এবং দিন-রাতের ভাবনায় ও অনুভবে। যাকে আমি ভালোবাসি তাকে নিয়ে লিখি কত রচনা ও কবিতা গান। তার স্মরণে উদ্দীপ্ত হই, অশ্রু ঝরাই। তার প্রতি প্রেম, ভক্তি ও শ্রদ্ধা মিশ্রিত আলোচনায় আমার রসনা সিক্ত হয়।
যাকে আমি ভালোবাসি ভালো লাগে তার সবকিছু। ভালো লাগে চলন ও বলন। ভালো লাগে তার জীবন যাপন। মনোমুগ্ধকর লাগে তার বক্তৃতা ও বয়ান। তার নীতি ও আদর্শ এবং ধারা ও ধরনকেই মনে হয় সর্বোৎকৃষ্ট। সবক্ষেত্রে তাই আমি তাকে অনুসরণ করতে চাই। সব বিষয়ে এবং সকল প্রসঙ্গে তাকেই প্রাধান্য দেই। তার ইচ্ছা ও পছন্দই অগ্রাধিকার দেই। তার আদেশ মান্য করতে, তার বারণ এড়িয়ে চলতে, তার উপদেশ পালন করতে এবং তার আবদার ও মিনতি রক্ষা করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করি। তার চিন্তা ও চেতনা এবং শিক্ষা ও আদর্শের চর্চা ও প্রসারে নিবেদিত হতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করি। ভালোবাসার এটাই ধর্ম, এটাই শিক্ষা।
যাকে ভালোবাসি তার তরে কষ্ট বরণ হয়ে যায় আনন্দের। তার জন্য ত্যাগ ও আত্মদান হয়ে যায় গৌরবের। তাকে ভালোবাসতে গিয়ে, ভালোবাসার দাবি রক্ষা করতে গিয়ে যত বিপদ ও পরীক্ষা নেমে আসে, যত আঘাত ও দুর্ভোগ ধেয়ে আসে নিমিষে তা মøান হয়ে যায় ভালোবাসার উত্তাপের কাছে। ভালোবাসার এটাই স্বভাব।
যাকে ভালোবাসি তার আনন্দে আমিও আনন্দিত এবং তার ব্যথায় আমিও ব্যথিত হই। তাকে কেউ আঘাত করলে সে আঘাত সরাসরি এসে লাগে আমার বুকে, আমার শরীরে। কেউ তাকে অসম্মান করলে আমি আহত হই। তাকে নিয়ে অবাস্তব কিছু বললে সংক্ষুব্ধ হই। তাকে কেউ কষ্ট দেবে এমন কথা কল্পনা করতেও কেঁপে উঠি। কেন? কারণ আমার ও তার আত্মা যে বাঁধা একই সুতোয়..!
আমার রাসূলকে, আমার প্রিয় নবীজী (সা.)-কে আমি যে ভালোবাসি, তাঁর ও আমার মাঝে ভালোবাসার সেই বন্ধনসূত্রটি হলো ঈমান। নবীর প্রতি ভালোবাসা একইসাথে ঈমান গ্রহণের ফলাফল এবং ঈমানদারের স্বীকৃতি লাভেরও পূর্বশর্ত। আমি মুমিন, তাই ভালোবাসি আমার নবীকে। আবার নবীকে ভালোবাসা ছাড়া আমি হতেই পারি না মুমিন! পেতে পারি না ঈমানের স্বাদ এবং মুমিন-হৃদয়ের তৃপ্তি ও শান্তি। নবীজীর বাণীতেই রয়েছে নবীপ্রেমের এই বৈশিষ্ট্যের কথা। তিনি বলেছেন : তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, পুত্র এবং সমস্ত মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় হই। (সহীহ বুখারী : ১৫; সহীহ মুসলিম : ৪৪)।
আমার নবীকে তাই আমি ভালোবাসি সকল মানুষের চেয়ে বেশি। তাঁকে ভালোবাসি সন্তান ও সম্পদ এবং পরিজন ও প্রিয়জনের চেয়েও বেশি। সৃষ্টিজগতের সবকিছুর চেয়ে, এমনকি নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি। কেননা নবীর প্রতি মুমিনদের এমন ভালোবাসাই তলব করেছেন রাব্বুল আলামীন : মুমিনদের কাছে নবী তাদের প্রাণের চেয়েও বেশি নিকটবর্তী আর তাঁর স্ত্রীগণ তাদের মা। (সূরা আহযাব : ৬)।
প্রাণের মায়া কার না আছে! মানুষ সবকিছুর মায়া ত্যাগ করতে পারে, কিন্ত জীবনের মায়া? মুমিনের কাছে নবীজীর ভালোবাসা তার জীবনের চেয়েও দামী। সাহাবীদের মাধ্যমে গোটা উম্মতকে এ ভালোবাসার অনুশীলন করিয়েছেন স্বয়ং নবীজী। উমর রা.-এর সঙ্গে নবীজীর সেই ঘটনাটিই এর সাক্ষী। একবার সাহাবীগণ ছিলেন রাসূলের কাছে। তিনি ধরে রেখেছিলেন উমর ইবনুল খাত্তাবের হাত। উমর তখন (ভালোবাসায় উদ্বেলিত হয়ে) বললেন, ‘আপনি আমার কাছে সবকিছুর চাইতে প্রিয়; শুধু আমার জান ছাড়া’। নবীজী বললেন, ‘যাঁর হাতে আমার প্রাণ, তাঁর শপথ করে বলছি, হবে না; যতক্ষণ না আমি তোমার কাছে তোমার প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয় হই।’ উমর এবার বললেন, ‘তাহলে এখন আপনি আমার কাছে আমার প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয়’। নবীজী বললেন, ‘এখন হয়েছে উমর!’ (সহীহ বুখারী : ৬৬৩২)।
নবীজী তাই আমার কাছে আমার প্রাণের চেয়েও আপন। ফুলের শোভা ও সৌরভ যেমন ভালোবাসি, পাখির কণ্ঠের সুমধুর গান যেমন ভালোবাসি- শুধু মনের টানে, মুমিন হিসেবে নবীর প্রতি আমার ভালোবাসা তেমনি স্বভাবজাত এবং তাঁর প্রতিই আমার টান সর্বাধিক। আমার মনের চূড়ামণিতে তাঁর অবস্থান। আমার হৃদয়ের সর্বোচ্চ আসনটি শুধুই তাঁর (সা.)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন